জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসতেই মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর হামলা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। জান্তা সরকারের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৮ ডিসেম্বর দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। তবে এই নির্বাচন ঘিরে দেশজুড়ে বিতর্ক, সমালোচনা ও অনাস্থার মধ্যেই বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন অঞ্চলে বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে সামরিক বাহিনী। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, যারা জীবন বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন।
চিন রাজ্যের একটি গ্রামে বসবাসকারী এক বাসিন্দা জানান, গত মাসের শেষের দিকে এক রাতে যুদ্ধবিমান উড়ে যেতে দেখেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাছাকাছি এলাকায় ধোঁয়া উঠতে শুরু করে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝে হাতের কাছে থাকা সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে পরিবারসহ এলাকা ছাড়েন তিনি। তাঁর মতোই গত কয়েক সপ্তাহে জান্তা বাহিনীর হামলার মুখে হাজার হাজার মানুষ বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত এলাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়ে গেছেন।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে বাংলাদেশ–সংলগ্ন রাখাইন রাজ্যে চালানো হামলায় অন্তত ৩০ জন নিহত হয়েছেন। এর আগে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে চিন রাজ্যে অন্তত তিনটি স্কুল ও ছয়টি গির্জায় হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় ছয় শিশুসহ মোট ১২ জন প্রাণ হারান। এসব অভিযোগের বিষয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে জান্তা সরকার কোনো মন্তব্য করেনি।
চিন রাজ্যের বাসিন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক হামলাগুলো গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাতের সূচনা হয় ২০২১ সালে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর। সেই অভ্যুত্থানের পর থেকেই বিরোধী মত দমনে কঠোর দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে জান্তা সরকার। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, এই সময়কালে দেশজুড়ে সহিংসতা, গ্রেপ্তার ও বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে জান্তা সরকার নিজেদের ক্ষমতা আরও সুসংহত করতে চায়। তবে এই নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরেও আপত্তি উঠেছে। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক শাসক দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অনেক নাগরিক মনে করছেন, চলমান সহিংসতার মধ্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। হামলার কারণে ঘরছাড়া এক ব্যক্তি বলেন, তাঁরা এই নির্বাচন চান না এবং আগের সময়েই সীমিত আকারে হলেও গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল বলে মনে করেন।
অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সেখানে ব্যাপক কারচুপির সম্ভাবনা রয়েছে। তাঁদের মতে, জান্তাসমর্থিত দলকে ভোট না দিলে ভোটের ফল জোরপূর্বক বদলে দেওয়া হতে পারে। বিদ্রোহী সংগঠনের এক শীর্ষ নেতা বলেন, এই নির্বাচন মূলত সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত করার একটি কৌশল, জনগণের মতামত প্রতিফলনের কোনো উদ্যোগ নয়।
বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত চিন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে জান্তা বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার চেষ্টাও বাড়ছে বলে জানা গেছে। যুদ্ধবিমান, ড্রোন ও কামানের গোলার সহায়তায় শত শত সেনা সেখানে ঢোকার চেষ্টা করছে। তবে পাহাড়ি ও ঘন জঙ্গলে ঢাকা ওই অঞ্চলে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি থাকায় সামরিক বাহিনীর জন্য অগ্রসর হওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
সেই অঞ্চলের একটি হাসপাতালে গিয়ে আহত বিদ্রোহী যোদ্ধাদের চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। কারও হাত বা পা কেটে ফেলতে হয়েছে গুরুতর আঘাতের কারণে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের সময় যাঁরা অনেকেই ছিলেন স্কুলপড়ুয়া, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাই এখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। তাঁদের একজন তরুণ যোদ্ধা একটি পা হারিয়েছেন, আরেকজনের শরীরেও গুরুতর ক্ষত রয়েছে। আহত অবস্থায় তিনি বলেন, সংঘর্ষের সময় স্থলমাইনের বিস্ফোরণে তাঁরা আহত হন এবং পরে আকাশপথে হামলা হয়। নিজের পা হারালেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভালো জীবন নিশ্চিত করতে হলে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত আছেন বলে জানান তিনি।
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে ঘিরে মিয়ানমারের সহিংসতা আরও বাড়বে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা কাটছে না। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের মধ্যেই দেশটি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।



