ভারত সফরে এসে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন আর্জেন্টাইন ফুটবল মহাতারকা লিওনেল মেসি। কলকাতা দিয়ে শুরু হয়ে হায়দরাবাদ, মুম্বাই ও দিল্লি ঘুরে শেষ হওয়া এই সফরটি ছিল পুরোপুরি বাণিজ্যিক। সফরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন দুই ঘনিষ্ঠ সতীর্থ, একজন উরুগুয়ের তারকা ফরোয়ার্ড ও একজন আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার। ইন্টার মায়ামির এই তারকাদের উপস্থিতি ঘিরে ফুটবলপ্রেমীদের উন্মাদনা থাকলেও, সফরের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে অর্থ লেনদেন এবং কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে ঘটে যাওয়া নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলা।
সেই বিশৃঙ্খলার রেশ গড়িয়েছে আদালত ও তদন্ত সংস্থার দোরগোড়ায়। তদন্তে নেমে ভারতের বিশেষ তদন্ত দল এমন কিছু তথ্য পেয়েছে, যা ইতিমধ্যে আলোচনার ঝড় তুলেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে জানা গেছে, পুরো সফরের জন্য একাই প্রায় ৮৯ কোটি রুপি পারিশ্রমিক পেয়েছেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক। সফরের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১০০ কোটি রুপিতে।
কলকাতার ঘটনায় আটক প্রধান আয়োজককে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই তথ্য পেয়েছে বিশেষ তদন্ত দল। বার্তা সংস্থা পিটিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পারিশ্রমিকের পাশাপাশি ভারত সরকারকে কর হিসেবে দেওয়া হয়েছে আরও প্রায় ১১ কোটি রুপি। অর্থাৎ সফর বাস্তবায়নে আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল বিপুল।
জিজ্ঞাসাবাদে আয়োজক দাবি করেছেন, মোট অর্থের প্রায় ৩০ শতাংশ এসেছে বিভিন্ন স্পনসর প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এবং আরও ৩০ শতাংশ এসেছে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে। বাকি অর্থের উৎস নিয়েই এখন প্রশ্ন তুলছেন তদন্তকারীরা। এরই মধ্যে আয়োজকের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে সেখানে ২০ কোটির বেশি রুপি পাওয়া গেছে। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, এই অর্থ কলকাতা ও হায়দরাবাদের ইভেন্ট ঘিরে টিকিট বিক্রি ও স্পনসরশিপ থেকে এসেছে। তবে তদন্ত দল এই দাবির সত্যতা যাচাই করছে। গত শুক্রবার আয়োজকের বাসভবনে অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিও জব্দ করা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঘটনা ঘটে ১৩ ডিসেম্বর সল্টলেক স্টেডিয়ামে। প্রিয় তারকাকে একঝলক দেখার আশায় হাজার হাজার দর্শক চড়া দামে টিকিট কিনে মাঠে প্রবেশ করেন। কিন্তু মাঠে নামার পর পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন ব্যক্তি আর্জেন্টাইন তারকাকে ঘিরে ধরেন, ফলে গ্যালারিতে বসে থাকা দর্শকদের বড় একটি অংশ তাঁকে দেখতেই পাননি।
এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন দর্শকেরা। শুরু হয় ভাঙচুর ও লুটপাট। স্টেডিয়ামের ভেতরে ও বাইরে পুলিশ ও দর্শকদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ এবং ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দিলেও মাঝপথ থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
এই ঘটনার পর প্রধান আয়োজককে হায়দরাবাদ যাওয়ার সময় বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তাঁকে ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠানো হয়। পুরো ঘটনার তদন্তে রাজ্য সরকার জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করে।
জিজ্ঞাসাবাদে আয়োজক আরও জানান, মাঠে প্রবেশের পর অতিরিক্ত ভিড় ও অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে অস্বস্তিতে পড়েন আর্জেন্টাইন তারকা। এ কারণেই তিনি পূর্বনির্ধারিত সময়ের আগেই মাঠ ছাড়েন। আয়োজকের ভাষ্য অনুযায়ী, বিদেশি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা আগেই জানিয়েছিলেন যে এই ফুটবলার পিঠে হাত দেওয়া বা জড়িয়ে ধরা পছন্দ করেন না।
অনুষ্ঠান চলাকালে রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রীকে বারবার মেসির খুব কাছাকাছি অবস্থানে দেখা যায়। বিভিন্ন ভিডিও ও ছবিতে দেখা গেছে, ছবি তোলার সময় তিনি তারকার কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। অভিযোগ উঠেছে, নিজের প্রভাব খাটিয়ে আত্মীয়স্বজন ও ব্যক্তিগত পরিচিতদের মাঠের ভেতরের এলাকায় প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক্রীড়ামন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
পিটিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কীভাবে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ মাঠের ভেতরের এলাকায় ঢোকার অনুমতি পেয়েছিলেন, সেটি এখন তদন্তের মূল বিষয়। আয়োজকের দাবি অনুযায়ী, শুরুতে মাত্র ১৫০টি গ্রাউন্ড পাস ইস্যু করা হয়েছিল। কিন্তু একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি স্টেডিয়ামে পৌঁছানোর পর সেই সংখ্যা তিন গুণ করা হয় এবং তিনিই পুরো পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেন। এই দাবির সত্যতা যাচাই করতেই তদন্ত এখন নতুন মোড়ে পৌঁছেছে।



