ফ্রান্সে চিকিৎসা পেশাকে কলঙ্কিত করা এক ভয়াবহ মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। রোগীদের সেবা দেওয়ার শপথ নেওয়া একজন চিকিৎসকই ইচ্ছাকৃতভাবে একের পর এক রোগীর শরীরে বিষ প্রয়োগ করেছেন বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। এই অপরাধের দায়ে ফ্রান্সের একটি আদালত তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। রাষ্ট্রপক্ষের ভাষায়, এই চিকিৎসক ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধীদের একজন।
দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি একজন অবেদনবিদ চিকিৎসক। বয়স ৫৩ বছর। পেশাগত জীবনের একসময় তাঁকে সহকর্মীরা অত্যন্ত দক্ষ ও প্রতিভাবান বলে মনে করতেন। অনেকেই তাঁকে ‘তারকা অবেদনবিদ’ হিসেবে আখ্যা দিতেন। অথচ সেই চিকিৎসকই অন্তত ৩০ জন রোগীর শরীরে ইচ্ছাকৃতভাবে বিষ প্রয়োগ করেছেন বলে আদালতে উঠে এসেছে। এসব ঘটনায় ১২ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এই ভয়াবহ কর্মকাণ্ডের কারণেই কৌঁসুলিরা তাঁকে ‘মৃত্যুর ডাক্তার’ বলে অভিহিত করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের এক কৌঁসুলি আদালতে বলেন, অভিযুক্ত চিকিৎসক একজন ক্রমিক খুনি এবং তাঁর মানসিকতা ছিল অত্যন্ত বিকৃত। তিনি পরিকল্পিতভাবে রোগীদের শরীরে এমন সব বিষ প্রয়োগ করতেন, যার ফলে হৃদ্রোগজনিত জটিলতা দেখা দিত এবং অনেক ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাক হতো। আরেক কৌঁসুলির বক্তব্য ছিল, এই ব্যক্তি আদতে কোনো চিকিৎসক নন, বরং একজন অপরাধী, যিনি মানুষ হত্যার জন্য ওষুধকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর বিষপ্রয়োগের শিকার রোগীদের বয়স ছিল চার বছর থেকে শুরু করে ৮৯ বছর পর্যন্ত।
ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলের একটি শহরের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে কাজ করার সময় কেন এবং কী উদ্দেশ্যে তিনি এই ভয়াবহ কাজ করেছেন, তা জানার জন্য প্রায় তিন মাস ধরে বিচারপ্রক্রিয়া চলে। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ তুলে ধরে যে, হত্যাকাণ্ডের পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য একেক সময়ে একেক রকম ছিল। কখনো তিনি নিজেই বিষ প্রয়োগের পর রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করতেন। তবে সেই চেষ্টা ছিল আসলে নিজের অপরাধ আড়াল করার কৌশল। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল সহকর্মীদের কাছে নিজেকে অধিক দক্ষ ও শক্তিশালী হিসেবে তুলে ধরা।
আদালতে আরও বলা হয়, যেসব সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব ছিল বা যাঁদের তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন, তাঁদের সুনাম ক্ষুণ্ন করতেই তিনি এমন কাজ করতেন। রোগীদের অসুস্থ করে তিনি পরিস্থিতি তৈরি করতেন, যাতে অন্য চিকিৎসকেরা ব্যর্থ প্রমাণিত হন এবং তিনি নিজে ‘উদ্ধারকারী’ হিসেবে সামনে আসতে পারেন। এই আচরণের মধ্য দিয়ে সহকর্মীদের অযোগ্য প্রমাণ করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, ক্ষমতার প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল এই চিকিৎসকের। নিজের পেশাগত অযোগ্যতা, হতাশা এবং ভেতরের শূন্যতা ঢাকতেই তিনি একের পর এক রোগীর জীবনের সঙ্গে এমন নৃশংস খেলা খেলেছেন। ধীরে ধীরে এই হত্যাকাণ্ডই তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয় বলে আদালতে উল্লেখ করা হয়।
রায়ের পর আদালত জানায়, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য অভিযুক্ত চিকিৎসক ১০ দিনের সময় পাবেন। তবে পুরো বিচারপ্রক্রিয়ায় তিনি নিজের অপরাধ স্বীকার করেননি। আদালতে তিনি দাবি করেন, তিনি কখনো কাউকে বিষ প্রয়োগ করেননি এবং তিনি কোনোভাবেই বিষ প্রয়োগকারী নন।
পারিবারিক দিক থেকে দেখা যায়, তাঁর বাবা নিজেও অবেদনবিদ ছিলেন। তাঁর স্ত্রী একজন হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তিনি একসময় বড় একটি বাড়িতে বসবাস করতেন। তবে কয়েক বছর আগে তাঁদের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে এবং বিচ্ছেদ হয়।
তদন্তে উঠে আসে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তিনি দুটি বেসরকারি ক্লিনিকে কাজ করেছেন। ওই সময়েই সেখানে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে রহস্যজনকভাবে হৃদ্রোগজনিত জটিলতা দেখা দিতে শুরু করে। একই সময়কালে অন্তত ১২ জন রোগীর মৃত্যু হয়, যা পরে এই মামলার ভিত্তি তৈরি করে।
এই মামলার সবচেয়ে মর্মান্তিক ভুক্তভোগীদের একজন ছিল চার বছরের এক শিশু। টনসিলের সমস্যার জন্য অস্ত্রোপচারের সময় তার শরীরে বিষ প্রয়োগ করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। অস্ত্রোপচারের সময় শিশুটির দুবার হৃদ্যন্ত্র বন্ধ হয়ে যায়। সৌভাগ্যক্রমে সে প্রাণে বেঁচে যায়। আদালতে শিশুটির বাবা বলেন, তাঁদের জীবনে যা ঘটেছে, তা এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো। চিকিৎসার ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রেখেই তাঁরা ক্লিনিকে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেই বিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সের বিচারব্যবস্থা এক ভয়াবহ অপরাধের কঠোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করল বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা।



