সৌদি আরবে চলতি বছরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিতে মোট ৩৪০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে এক বছরে এত বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা এর আগে কখনো দেখা যায়নি।
সৌদি সরকারের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ঘোষণার তথ্যের ভিত্তিতে বার্তা সংস্থা এএফপি এই হিসাব প্রকাশ করেছে। সর্বশেষ গত সোমবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থায় প্রকাশিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, এক সুদানের নাগরিককে হত্যার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তিন সৌদি নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। ওই দণ্ড কার্যকর করা হয় মক্কা অঞ্চলে।
চলতি বছরে এই তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে সৌদি আরবে মোট কার্যকর হওয়া মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৪০-এ। এর আগে ২০২৪ সালে এক বছরে সর্বোচ্চ ৩৩৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রেকর্ড ছিল। নতুন পরিসংখ্যান সেই রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে গেছে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০২৫ সালে যাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ২৩২ জনই মাদকসংক্রান্ত মামলায় দোষী সাব্যস্ত ছিলেন। অর্থাৎ মোট মৃত্যুদণ্ডের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি এসেছে মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধ থেকে। এই প্রবণতাই সামগ্রিকভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। একই ধরনের চিত্র গত বছরও লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যও এই বাস্তবতাকে তুলে ধরছে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, চীন ও ইরানের পর সৌদি আরব ২০২২, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে টানা তিন বছর বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেশ হিসেবে অবস্থান করেছে। লন্ডনভিত্তিক এই সংস্থাটি জানায়, ২০২৪ সালে সৌদি আরবে রেকর্ড ৩৩৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ১৯৯০ সাল থেকে সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের তথ্য নিয়মিতভাবে অনুসরণ ও নথিভুক্ত করে আসছে। সংস্থাটির দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে মাদকসংক্রান্ত অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এই প্রবণতাকে সৌদি কর্তৃপক্ষের ঘোষিত মাদকবিরোধী অভিযানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করছেন। ২০২৩ সাল থেকে দেশটিতে মাদকবিরোধী যে কঠোর অভিযান শুরু হয়েছে, সেটিকে অনেকেই কার্যত একটি ‘যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্যাপটাগন নামের মাদক নিয়ন্ত্রণে আনা এবং মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এর বিস্তার রোধ করা।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে ক্যাপটাগনের অন্যতম বৃহৎ বাজার হিসেবে বিবেচিত। ফলে মাদকটির উৎপাদন, পাচার ও ব্যবহার রোধে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে মাদকসংক্রান্ত অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রায় তিন বছর ধরে মাদকসংক্রান্ত অপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর কার্যত স্থগিত রাখার পর ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে সৌদি আরব আবারও এই সাজা দেওয়া ও কার্যকর করা শুরু করে। এরপর থেকেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে এবং ২০২৫ সালে এসে তা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক পরিসরে মানবাধিকার ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। তবে সৌদি কর্তৃপক্ষের অবস্থান হলো, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তারা কঠোর আইন প্রয়োগে অনড় থাকবে।



