হেমন্তের শেষ প্রান্তে এসে প্রকৃতি যেন ধীরে ধীরে এক নতুন অধ্যায়ে পা রাখে। বিকেলের আলো তখন আর তীব্র থাকে না, নরম ছায়ার সঙ্গে মিশে থাকে হালকা কুয়াশা। বাতাসে ভেসে আসে ধানের পরিচিত ঘ্রাণ। মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা কাটা ধানের নাড়াগুলো জানান দেয়, আরেকটি কৃষিজ মৌসুম তার দায়িত্ব শেষ করেছে। এই সময়টায় প্রকৃতির রঙ, গন্ধ আর শব্দে পরিবর্তনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই পরিবর্তনের মাঝেই আসে শীতের প্রথম বার্তা। ভোরবেলায় ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির, দূর আকাশে উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখির সারি আর বাতাসের শীতল ছোঁয়া বুঝিয়ে দেয়, ঋতুচক্র নতুন পথে এগোচ্ছে। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস শীতকাল হিসেবে পরিচিত। গতকাল মঙ্গলবার ছিল শীত ঋতুর প্রথম দিন। হেমন্তের মৃদু শীতলতা যখন শরীরকে প্রস্তুত করে, তখন শীত তার নিজস্ব ছন্দে দৃঢ়ভাবে উপস্থিত হয়।
গ্রামের জীবনে শীতের উপস্থিতি ধরা পড়ে আলাদা এক আবহে। ঘরে ঘরে ধান ভানা আর চাল কোটার শব্দে তৈরি হয় এক ধরনের চেনা সুর। সেই সুরের সঙ্গে মিশে থাকে খড়কুটোর গন্ধ আর ভোরের কুয়াশা। শীতের সকাল এখানে অন্য রকম। সূর্যের প্রথম আলো যখন শিশিরবিন্দুতে পড়ে ঝিলমিল করে ওঠে, তখন প্রকৃতি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। কুয়াশায় মোড়া গাছপালা আর দূরের ধানখেতের ওপর আলোছায়ার খেলায় তৈরি হয় এক মায়াবী দৃশ্য। এই দৃশ্য বাংলার সাহিত্য ও কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে, শীতকে করে তুলেছে আবেগময়।
রাজধানী ঢাকায় শীতের রূপ কিছুটা ভিন্ন হলেও অনুভূতিটা আলাদা নয়। হালকা শাল, পশমি সোয়েটার আর গরম কাপড় মানুষের দৈনন্দিন পোশাকে জায়গা করে নেয়। পত্রিকা ও টেলিভিশনে পেট্রোলিয়াম জেলি, বডি লোশন ও ময়েশ্চারাইজারের বিজ্ঞাপন বাড়তে থাকে। গুলিস্তান, পল্টন, মতিঝিলসহ বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতে শীতের পোশাকের পসরা বসে। চেনা যানজট আর ব্যস্ততার মাঝেও বাতাসে শীতের পরিমিত ঠান্ডা শহরের ছন্দে নতুন মাত্রা যোগ করে।
শীতের আরেকটি অনিবার্য অনুষঙ্গ পরিযায়ী পাখি। দূর উত্তরাঞ্চল থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে তারা বাংলাদেশের জলাশয়, হাওর ও বিলে আশ্রয় নেয়। পানিতে ডুবসাঁতার, ডানা ঝাপটানো আর আকাশে দলবদ্ধ উড্ডয়নে শীতের প্রকৃতি হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত ও রঙিন।
গ্রামের জীবনে শীত মানেই পিঠাপুলির মৌসুম। নতুন ধানের গুঁড়া, উনুনে জ্বলা খড়কুটো আর গলানো গুড়ের মিষ্টি গন্ধে চারপাশ ভরে ওঠে। পুলি, ভাপা, চিতইসহ নানা ধরনের পিঠা শুধু খাবার নয়, পারিবারিক বন্ধনের প্রতীক হয়ে ওঠে। কেউ নিজেরা উপভোগ করে, কেউ আবার আত্মীয়স্বজনের জন্য পাঠিয়ে দেয়। শীত মানুষের মধ্যে ধীরতা আনে, উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
শহরেও পিঠার আমেজ কম নয়। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত রাস্তার ধারে ধোঁয়া ওঠা স্টলের সামনে ভিড় জমে। নানা বয়সের মানুষ শীতের এই বিশেষ স্বাদ নিতে ভোলেন না।
এই ঋতুতে গাছের বৃদ্ধি ধীর হয়ে আসে, বিবর্ণ পাতা ঝরে পড়ে। রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা ওসমানী উদ্যান প্রকৃতির এই পরিবর্তনের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে। তবে শীতের মাঝেও রঙের কমতি নেই। গাঁদা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, কসমস, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, গাজানিয়া, লিলিয়াম ও ডায়ান্থাস ফুল কুয়াশার দিনের মাঝেও উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দেয়।
শীতকাল মানেই মাঠে মাঠে ফসলের বৈচিত্র্য। পালংশাক, শর্ষে, বেগুন, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, শিম, ধনেপাতাসহ নানা সবজির চাষ বাড়ে। এসব ফসল প্রতিদিন শহরের বাজারে পৌঁছালেও দামের দিক থেকে নগরবাসীর স্বস্তি পুরোপুরি ফেরে না।
পুকুর, ডোবা ও নদীর পানি কমে এলে মাছ শিকারের দৃশ্যও বাড়ে। পুঁটি, মলা, ঢ্যালা, ট্যাংরা, কাচকি, চিংড়ির পাশাপাশি বড় আকারের বোয়াল, শোল, আইড়, চিতল, রুই, পাঙাশসহ নানা মাছ বাজারে দেখা যায়।
তবে শীতের আনন্দের পাশাপাশি কিছু বাস্তবতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় দায়বদ্ধতার কথা। পথশিশু, ছিন্নমূল মানুষ আর ফুটপাতে রাত কাটানো শ্রমজীবীদের কাছে শীত কষ্টের নাম। বিশেষ করে দেশের উত্তরের জেলাগুলোতে শীত বেশি তীব্র হয়। শিশু ও বয়স্করা এতে বেশি ভোগে, সর্দি, কাশি, জ্বর ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়ে।
শীত তাই শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, মানবিক দায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দেয়।



