যেদিকে চোখ যায়, শুধু বিস্তীর্ণ মরুভূমি আর সারি সারি রুক্ষ পাহাড়। চারপাশে নেই সবুজের ছোঁয়া, নেই পিপাসা মেটানোর একফোঁটা পানিও। প্রচণ্ড রোদ আর শুষ্ক বাতাসে ভূমি ফেটে চৌচির। এমন পরিবেশেই অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত ডেথ ভ্যালি, যার নামই যেন এই অঞ্চলের বাস্তবতা তুলে ধরে। দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকা পরিচিত ছিল একেবারেই পানিশূন্য ও প্রাণহীন উপত্যকা হিসেবে। অথচ চলতি বছর সেই ডেথ ভ্যালিতেই আবার প্রাণের চিহ্ন দেখা দিয়েছে। বহু হাজার বছর আগে শুকিয়ে যাওয়া একটি প্রাচীন হ্রদ নতুন করে জেগে উঠেছে।
এই হ্রদের বয়স সাধারণ কোনো হিসাবের মধ্যে পড়ে না। এটি শত কিংবা হাজার বছরের নয়, বরং প্রায় এক লাখ ২৮ হাজার থেকে এক লাখ ৮৬ হাজার বছরের পুরোনো একটি প্রাকৃতিক জলাধার। সেই প্রাচীন সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়েরা নাভাদা অঞ্চল ছিল হিমবাহে আচ্ছাদিত। বিশাল বরফস্তর গলে যে পানি নেমে এসেছিল, তা জমে তৈরি করেছিল এক বিশাল হ্রদ। গবেষণায় দেখা গেছে, তখন এই হ্রদের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১৬০ কিলোমিটার। স্থানীয়ভাবে পরিচিত এই জলাধারকে এখন ‘ম্যানলি লেক’ নামে ডাকা হয়।
ম্যানলি লেকের অবস্থানও ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে নিচু ভূখণ্ডে অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৮২ ফুট নিচে এর অবস্থান। বছরের অধিকাংশ সময় এখানে থাকে চরম শুষ্কতা। তীব্র রোদ, গরম বাতাস আর অনাবৃষ্টিতে পুরো এলাকা পরিণত হয় রুক্ষ ও নিষ্ঠুর এক মরুভূমিতে। সেই কারণে বহু বছর ধরেই ম্যানলি লেক ছিল কেবল ইতিহাস আর ভূতাত্ত্বিক গবেষণার অংশ। বাস্তবে সেখানে পানি দেখার সুযোগ খুব কমই মিলত।
তবে চলতি বছর প্রকৃতি যেন ব্যতিক্রমী আচরণ করেছে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই এলাকায় একের পর এক ঝড় ও প্রবল বৃষ্টিপাত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র তিন মাসে সেখানে মোট ২ দশমিক ৪১ ইঞ্চি বৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু নভেম্বর মাসেই রেকর্ড পরিমাণ ১ দশমিক ৭৬ ইঞ্চি বৃষ্টি ঝরেছে। এর আগে ১৯২৩ সালে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৭ ইঞ্চি বৃষ্টির রেকর্ড ছিল, যা শত বছরেরও বেশি সময় ধরে অক্ষত ছিল। এবারের বৃষ্টিপাতে সেই পুরোনো রেকর্ড ভেঙে গেছে।
এই অস্বাভাবিক বৃষ্টির ফলেই ডেথ ভ্যালির নিচু ভূমিতে আবার পানি জমতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সেই পানি একত্রিত হয়ে ম্যানলি লেকের আদলে একটি বিস্তৃত জলাধার তৈরি করেছে। ফলে বহুদিন পর এই মরুভূমির বুকে দেখা মিলেছে জলরাশির। পানির উপস্থিতিতে পুরো এলাকার চেহারাই বদলে গেছে। পর্যটক ও প্রকৃতিপ্রেমীদের দৃষ্টি এখন নতুন করে এই হ্রদের দিকে।
তবে এটি প্রথমবার নয় যে ম্যানলি লেক আবার জেগে উঠেছে। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে। দুই বছর আগে ঘূর্ণিঝড় হিলারির প্রভাবে পুরো এলাকা ব্যাপক ঝড়বৃষ্টির কবলে পড়েছিল। সে সময় চলতি বছরের তুলনায় আরও বেশি পানি জমেছিল হ্রদে। তখন কিছু সময়ের জন্য সেখানে নৌকা চালানোর সুযোগও তৈরি হয়েছিল, যা পর্যটকদের জন্য ছিল এক বিরল অভিজ্ঞতা। মরুভূমির মাঝখানে নৌকাভ্রমণ সেই সময় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
প্রকৃতিবিদদের মতে, ডেথ ভ্যালির মতো চরম শুষ্ক এলাকায় এ ধরনের ঘটনা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও নির্দেশ করে। অল্প সময়ের মধ্যে অতিবৃষ্টি এবং দীর্ঘদিনের শুকনো হ্রদের পুনর্জাগরণ পরিবেশগত পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও এই হ্রদের পানি স্থায়ী হবে না এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, তবু এটি প্রাকৃতিক ইতিহাসের এক জীবন্ত স্মারক হয়ে উঠেছে।
লাখো বছর আগের এক হ্রদের ক্ষণিকের প্রত্যাবর্তন মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রকৃতি কখনোই পুরোপুরি স্থির নয়। সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যাওয়া জলাধারও সুযোগ পেলে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, এমনটাই দেখাল ডেথ ভ্যালির ম্যানলি লেক।



