বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিলাসবহুল হোটেল ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে নীরব কিন্তু তীব্র এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। লক্ষ্য সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং অতিধনীদের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং ব্র্যান্ড মর্যাদার নতুন উচ্চতা ছোঁয়া। বিলাসী ইয়ট পরিষেবাকে ঘিরে এই প্রতিযোগিতায় ইতিমধ্যে কয়েকটি নাম নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে, আর বাকিরা প্রস্তুতি নিচ্ছে সমুদ্রে নামার।
২০২২ সালে একটি আন্তর্জাতিক হোটেল ব্র্যান্ড প্রথমবারের মতো নিজস্ব ইয়ট পরিষেবা চালু করার পর বিষয়টি দ্রুত অন্য ব্র্যান্ডগুলোর নজর কাড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় আরও কয়েকটি বিশ্বখ্যাত হসপিটালিটি গ্রুপ নিজেদের বিলাসী ইয়ট বহর চালুর ঘোষণা দিয়েছে। আগামী বছর থেকে পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে একের পর এক নতুন ইয়ট সমুদ্রে নামবে, যা বিলাসী ভ্রমণের সংজ্ঞাকেই নতুন করে সাজিয়ে দেবে।
এই ইয়টগুলো কেবল ভ্রমণের মাধ্যম নয়, বরং ভাসমান পাঁচতারকা হোটেল। কোথাও থাকছে মিশেলিন তারকাপ্রাপ্ত শেফের তত্ত্বাবধানে খাবার, কোথাও বিশাল আকারের স্যুট, আবার কোথাও অনবোর্ড টেইলার বা ব্যক্তিগত স্পা। তবে এসব সুযোগ সুবিধার বাইরেও সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হয়ে উঠছে ইয়টের গায়ে থাকা ব্র্যান্ডের নাম। অতিধনী ভ্রমণকারীদের কাছে সেই পরিচিত লোগোটাই আস্থা ও মর্যাদার প্রতীক।
এই নতুন ধরণের ক্রুজিং মূলত তাদের জন্য, যারা সাধারণ ক্রুজ ভ্রমণে আগ্রহী নন। সংশ্লিষ্ট একটি বৈশ্বিক হোটেল গ্রুপের বিলাসবহুল বিভাগের প্রধান জানান, তাদের ইয়ট অভিজ্ঞতা ব্যক্তিগত ইয়ট এবং প্রচলিত বিলাসী ক্রুজের মাঝামাঝি একটি জায়গা দখল করে আছে। এখানে অতিথিরা পান ব্যক্তিগত ইয়টের ঘনিষ্ঠতা এবং বড় ব্র্যান্ডের পরিপক্ব সেবা একসঙ্গে।
বর্তমানে চালু থাকা ইয়টগুলোর বেশিরভাগই ভূমধ্যসাগর ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে চলাচল করছে। এসব ইয়টে থাকা স্যুটের সংখ্যা শতাধিক এবং নতুন অতিথিদের মতামত অনুযায়ী নকশা ও সুযোগ সুবিধায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। যেমন আরও বেশি সুইমিং পুল বা বড় খোলা ডেক। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ইয়টের অর্ধেকের মতো অতিথিই জীবনে প্রথমবারের মতো ক্রুজ অভিজ্ঞতা নিচ্ছেন, তবে তারা আগেও একই ব্র্যান্ডের হোটেলে থেকেছেন।
অন্য ব্র্যান্ডগুলোও অতিথির এই আনুগত্যকে কাজে লাগাতে চাইছে। একটি আন্তর্জাতিক বিলাসী হোটেল গ্রুপের ইয়ট বিভাগের প্রধান নির্বাহী বলেন, তাদের নিয়মিত অতিথিরা ব্র্যান্ডের প্রতি গভীর আবেগ অনুভব করেন এবং নতুন অভিজ্ঞতার জন্য প্রস্তুত থাকেন। সে কারণেই ইয়টগুলোকে এমনভাবে ডিজাইন করা হচ্ছে যেন সেগুলো সমুদ্রের বুকে একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত পরিশীলিত বুটিক হোটেলের মতো অনুভূত হয়।
আরেকটি ব্র্যান্ড তুলনামূলক ছোট আকারের ইয়ট আনছে, যেখানে স্যুট সংখ্যা কম হলেও নকশায় জাপানি রিওকান ঘরানার ছাপ থাকবে। অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা থেকে শুরু করে স্পা পর্যন্ত থাকবে জাপানি নান্দনিকতার প্রভাব, এমনকি বাগানও থাকবে সেই ধারায়।
এদিকে ঐতিহ্যবাহী এক ভ্রমণ ব্র্যান্ড তাদের ইতিহাসকে সামনে এনে আর্ট ডেকো ঘরানার একটি বিশাল পালতোলা ইয়ট আনছে। এই ইয়টের নকশা বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের ভ্রমণের স্বর্ণযুগকে স্মরণ করিয়ে দেবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী জানান, উদ্দেশ্য শুধু বিলাসিতা নয়, বরং সেই সময়ের শিল্পকলা ও কারুশিল্পকে নতুন করে সংরক্ষণ ও উপস্থাপন করা।
সেবার ক্ষেত্রেও প্রতিটি ইয়ট নিজ নিজ ব্র্যান্ড পরিচয় বজায় রাখছে। কোথাও কর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে অতিথির সমস্যা সমাধানে নির্দিষ্ট অঙ্ক পর্যন্ত খরচ করার ক্ষমতা রাখেন, কোথাও আবার অতিথিদের আনা নেওয়ার জন্য আলাদা বিলাসী টেন্ডার বোট রাখা হয়েছে। কোনো ইয়টে থাকছে গোপন স্পিকইজি বার, আবার কোথাও ব্ল্যাক টাই নৈশভোজ এবং অনবোর্ড দর্জি।
খাবারের ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা কম নয়। একাধিক ইয়টে বিশ্বখ্যাত শেফদের তত্ত্বাবধানে রেস্তোরাঁ পরিচালিত হবে। আবার কিছু নির্দিষ্ট রুটে হোটেল ব্র্যান্ডগুলোর নিজস্ব মিশেলিন তারকাপ্রাপ্ত রেস্তোরাঁর শেফরা অতিথিদের জন্য বিশেষ মেনু পরিবেশন করবেন।
ভ্রমণের বহু আগেই অতিথিদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়, কখনো এক থেকে দুই বছর আগে। উদ্দেশ্য একটাই, অতিথির পছন্দ, অভ্যাস ও মনের অবস্থার সঙ্গে মিল রেখে অভিজ্ঞতা সাজানো। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একে বলছেন অতিরিক্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক সেবার যুগ।
আগামী দিনের রুট পরিকল্পনায় ভূমধ্যসাগর ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের পাশাপাশি এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, আলাস্কা ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার মতো এলাকাও যুক্ত হচ্ছে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত চার্টার ও বিশেষ ইভেন্টের ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে।
সব মিলিয়ে, বিলাসী ইয়ট যুক্ত করা এসব হোটেল ব্র্যান্ডের জন্য স্বাভাবিক এক সম্প্রসারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইউরোপের বিভিন্ন শিপইয়ার্ডে একের পর এক ইয়ট নির্মাণ চলায় বোঝা যাচ্ছে, এই খাতে সম্ভাবনা নিয়ে তারা বেশ আশাবাদী। শিল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, এই প্রতিযোগিতার শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় লাভবান হবেন অতিথিরাই।



