কক্সবাজার উপকূলে ইলিশের মৌসুম থাকলেও জেলেদের জালে মিলছে না প্রত্যাশিত মাছ। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ ট্রলারমালিক ও জেলেরা জানাচ্ছেন, গত দশ বছরে এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি। সামান্য যে ইলিশ ধরা পড়ছে, তার আকারও আশানুরূপ নয়। বেশির ভাগের ওজন ৩০০ থেকে ৪৫০ গ্রামের মধ্যে আটকে আছে, যেখানে গত বছরের একই সময়ে গড় ওজন ছিল প্রায় দ্বিগুণ। গবেষকরা বলছেন, দূষণ, বৃষ্টিপাতের ঘাটতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণ এই ব্যতিক্রমী অবস্থার পেছনে থাকতে পারে, তবে নিশ্চিত হওয়ার মতো বিস্তৃত গবেষণা এখনো হয়নি।
বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূলে এখন ইলিশের ভরা মৌসুম। গত বছরের এ সময়ে জেলেদের জালে গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ উঠেছিল, এমনকি ২২০০ গ্রাম ওজনের কিছু ইলিশও পাওয়া গিয়েছিল। এবার সেই চিত্র একেবারেই উল্টো। ট্রলারমালিকরা বলছেন, গত ছয় থেকে সাত মাস ধরে ধারাবাহিক সাগর অস্থিরতা, লঘুচাপ ও নিম্নচাপের কারণে বারবার লোকসান গুনতে হয়েছে। বহু ট্রলারমালিক দেউলিয়ার পথে। জেলে পরিবারগুলো পড়েছে গুরুতর অর্থসংকটে। এখন যে সামান্য ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে, তাও আকারে ছোট আর পরিমাণে কম হওয়ায় প্রতিটি ট্রলারই লোকসানে পড়ছে। পরিস্থিতি ঠিক কবে বদলাবে, তা নিয়ে কেউই নিশ্চিত উত্তর দিতে পারছেন না।
জেলার ট্রলার সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার, আর এসব ট্রলারে কাজ করেন প্রায় এক লাখ বিশ হাজার জেলে ও শ্রমিক। মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় অন্তত ৫০টি পয়েন্টে এখন ৮ থেকে ১০ মেট্রিক টন করে ইলিশ ধরা পড়ছে, যা গত অক্টোবর ও নভেম্বরে ছিল দৈনিক গড়ে ২০ মেট্রিক টন। গত অর্থবছরে জেলায় মোট ইলিশ আহরণ ছিল ৪০ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪২ হাজার টন, কিন্তু চলমান পরিস্থিতি সেই লক্ষ্য পূরণ নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে।
কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, শুধু কক্সবাজার নয়, দেশের সব উপকূলীয় এলাকাতেই ছোট আকারের ইলিশ ধরা পড়ছে। এটি আগে দেখা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তন এর পেছনে ভূমিকা রাখছে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মৎস্যবিশেষজ্ঞরা সম্ভাব্য দুটো কারণ উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, নদী ও সাগরের দূষণ বেড়ে যাওয়ায় পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ইলিশের বিচরণ, প্রজনন ও বেড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে।
নুনিয়াছটা ফিশারি ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, সাগর থেকে ফিরে আসা বেশ কয়েকটি ট্রলারের জালে সামান্য ইলিশ মিলেছে। একটি ট্রলারে ধরা পড়েছে ৬০০টি ইলিশ, যার ওজন ৩৫০ থেকে ৪০০ গ্রাম। জেলেদের দাবি, একই সময়ে গত বছর একই এলাকায় জাল ফেলেই ২০ হাজারের বেশি ইলিশ পেয়েছিলেন তারা, যার গড় ওজন ছিল প্রায় ৮০০ গ্রাম। এবার কেন ইলিশের আকার ছোট হচ্ছে, তার কারণ তারা খুঁজে পাচ্ছেন না।
বাজারেও একই চিত্র। ঘাটে প্রতিদিন আসছে হাজারখানেক ছোট ইলিশ, যা পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৯০০ থেকে ১২০০ টাকায়। বাজারে খুচরায় সেই দাম আরও ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি। ঘাট থেকে ইলিশ নিয়ে প্রতিদিনই ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে কয়েক মেট্রিক টন। তবে গত বছরের তুলনায় তা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এবার দৈনিক সরবরাহ তিন মেট্রিক টনের মতো, যেখানে গত বছর ছিল ৩০ মেট্রিক টনের বেশি।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক জানান, সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিদিন তিন মেট্রিক টন ইলিশ বিক্রি হলেও অধিকাংশই ছোট আকারের। কেন এমন হচ্ছে, তা জানার জন্য জরুরি গবেষণা প্রয়োজন। মৎস্য বিভাগের হিসেবে, চলতি ডিসেম্বরের প্রথম নয় দিনে ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৯৪ দশমিক ১১ মেট্রিক টন। গত অক্টোবরে ছিল ২১০ মেট্রিক টন, আর আগের বছর একই মাসে ছিল ৩০৫ মেট্রিক টন। সব মিলিয়ে ইলিশের ঘাটতি ও আকার দুইই কমে যাচ্ছে, যা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানান, নিষেধাজ্ঞা শেষের পর ২৫ অক্টোবর থেকে জেলেরা সাগরে নামে। শুরুতে কিছু ইলিশ মিললেও এখন তা প্রায় নেই বললেই চলে। দূষণ, বৃষ্টি কম হওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তন এ পরিস্থিতির সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। তবে আরও বিশদ গবেষণা ছাড়া সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন।



