Monday, December 1, 2025
spot_img
Homeকমিউনিটি সংবাদনিউইয়র্কে অভিবাসী পথবিক্রেতাদের লড়াই

নিউইয়র্কে অভিবাসী পথবিক্রেতাদের লড়াই

জ্যাকসন হাইটসের ব্যস্ত ফুটপাথে সাজানো রঙিন চুড়ি, সোনালি নেকলেস আর ফুলেল কুর্তার ছোট টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বাংলাদেশি বিক্রেতা। মুখে হাসি থাকলেও চোখে ছিল সতর্কতা। সম্ভাব্য ক্রেতার মতোই খুঁজছিলেন সাদাসিধে পোশাকে আসা পরিদর্শকদের। তাঁর আয়ের প্রতিটি দিন নির্ভর করে সেই দৃষ্টি এড়ানোর ওপর।

চট্টগ্রাম থেকে পরিবারসহ নিউইয়র্কে আসার পর এক দশকের বেশি সময় পেরোলেও তাঁর সাফল্যের স্বপ্ন রয়ে গেছে অপূর্ণ। জ্যাকসন হাইটসের পরিচিত গন্ধ আর ভাষা তাঁকে স্বস্তি দিলেও স্থায়ী জীবিকা গড়ার পথে বহাল রয়েছে অদৃশ্য দেয়াল। ছয় বছর আগে তিনি স্ট্রিট ভেন্ডর পারমিটের জন্য আবেদন করেছিলেন। বারবার খোঁজ নিয়েও একই উত্তর পেয়েছেন। তিনি এখনো অপেক্ষমান তালিকায়। মেয়ের স্কুলজীবন শেষ হয়ে বিয়েও হয়ে গেছে, কিন্তু তাঁর হাতে এখনো সেই কাঙ্ক্ষিত লাইসেন্স পৌঁছায়নি।

এই একটানা অপেক্ষা নিউইয়র্ক শহরের হাজারো পথবিক্রেতার বাস্তবতা। দক্ষিণ এশিয়া ও লাতিন আমেরিকা থেকে আসা বহু অভিবাসী খাবার, পোশাক বা ছোট পণ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু শহরের পুরনো ও সীমাবদ্ধ পারমিট ব্যবস্থার কারণে বৈধভাবে ব্যবসা চালানোর সুযোগ নেই। ফলে তারা জরিমানা, পণ্য জব্দ হওয়া এবং গ্রেপ্তারের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

কুইন্সের একজন সিটি কাউন্সিল সদস্য দীর্ঘদিন ধরে ভেন্ডিং সংস্কারের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর উদ্যোগে শহরে স্ট্রিট ভেন্ডিং অপরাধ হিসেবে গণ্য না করে সিভিল লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হবে এমন একটি বিল চলতি বছরের শেষের দিকে কার্যকর হওয়ার কথা। সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে পুলিশি অভিযানে বড় ধরনের বৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৩ সালে যেখানে ৪ হাজারের কিছু বেশি টিকিট দেওয়া হয়েছিল, ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা ৯ হাজারের বেশি।

ফুটপাথে সামান্য ভুল স্থান নির্বাচন, কার্ট খুঁটির সঙ্গে ঠেকিয়ে রাখা, কিংবা কার্ডবোর্ডের ওপর পণ্য সাজানোর মতো কারণেও বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। এসব লঙ্ঘনে পাঁচশ ডলার পর্যন্ত জরিমানা কিংবা ৩০ দিন পর্যন্ত জেল হতে পারে। বৈধ পারমিট ছাড়া কাজ করলে জরিমানা হাজার ডলার পর্যন্ত পৌঁছায় এবং সাজা হতে পারে তিন মাস।

নতুন বিলে গ্রেপ্তার বা জেলের ঝুঁকি না থাকলেও জরিমানার পরিমাণ কমবে না। সময়, স্থান বা নিয়ম লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জরিমানা দুই শত পঞ্চাশ ডলার এবং পারমিট ছাড়া ব্যবসা করলে এক হাজার ডলার।

নানান সীমাবদ্ধতার কারণে শহরে এখনো ২০ হাজারের বেশি আবেদনকারী লাইসেন্সের অপেক্ষায়। খাদ্যবিক্রেতাদের জন্য দুই ধরনের পারমিট প্রয়োজন, কিন্তু এর বাস্তবায়নও অত্যন্ত ধীরগতির। ২০২১ সালে গৃহীত একটি আইনে খাবারের পারমিট ধাপে ধাপে বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সংখ্যার তুলনায় কার্যকর পারমিট সংখ্যা এখনো অনেক কম।

অন্যদিকে যাঁরা পোশাক বা অন্যান্য পণ্য বিক্রি করেন, তাঁদের লাইসেন্সও কঠোরভাবে সীমিত। আবেদন তালিকা ২০০৬ সালেই বন্ধ হয়ে গেছে। এতে দশ হাজারের বেশি আবেদনকারী আটকে রয়েছেন। সীমাবদ্ধতার সুযোগে গড়ে উঠেছে কালোবাজার যেখানে বৈধ কাগুজে পারমিটের মূল্য বছরে কয়েকশ ডলার হলেও অবৈধ পারমিট বেচাকেনায় বছরে ১৭ হাজার থেকে ২৫ হাজার ডলার পর্যন্ত দিতে হয়।

কমিউনিটি সার্ভিস সংস্থার একজন সাবেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বিক্রেতাদের নিয়ম ও অধিকার সম্পর্কে পর্যাপ্ত শিক্ষা না থাকায় তারা সহজেই কালোবাজারে জড়িয়ে পড়েন। অনেকে ঋণের বোঝা শোধ করতে না পেরে বছরের পর বছর সেই চক্রে আটকে থাকেন।

ফুটপাথের এক খাবার বিক্রেতার অভিজ্ঞতাও একই। তিনিও অপেক্ষমান তালিকার সদস্য। আগে তিনি মাসে হাজার ডলারের মতো দিয়ে কালোবাজারি পারমিট ভাড়া করেছিলেন, কিন্তু মহামারির সময় বিক্রি কমে যাওয়ায় তা আর ধরে রাখতে পারেননি। তিনি জানান, কখনো দিনে সত্তর ডলার আয় হলেও জরিমানা দিতে হয়েছে দুইশ ডলার। কখনো কখনো পুলিশের অভিযানে তাঁর কার্ট জব্দ হয়ে গেছে, যা ফেরত পেতে দিতে হয়েছে হাজার ডলার।

স্ট্রিট ভেন্ডর প্রজেক্টের সঙ্গে কাজ করা এক সংগঠক জানান, ধর্মীয় উৎসব বা ছুটির দিনে যখন ব্যবসা একটু বাড়ে, তখনই অভিযানের সংখ্যা বেড়ে যায়। তাঁর মতে, নিয়মিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, বরং শিক্ষা, নির্দেশনা এবং লাইসেন্স বৃদ্ধির ওপর শহরের গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

অন্যদিকে অনেক বিক্রেতার ফিরে যাওয়ার আর কোনো পথ নেই। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ব্যক্তিগত ক্ষতির কারণে নিজের দেশে আর নিরাপত্তা নেই বলে জানান সেই বয়স্ক বিক্রেতা। তাঁর কথায়, নিউইয়র্কে জীবন কঠিন হলেও অন্তত তিনি বাঁচতে পারছেন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments