গাজায় অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির পর টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা ও বিধ্বস্ত অঞ্চলের পুনর্গঠনে অগ্রসর হতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সোমবার যুক্তরাষ্ট্র প্রণীত একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। ১৫ সদস্যের পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটে ১৩টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে মত দেয়, আর রাশিয়া ও চীন বিরত থাকে। তবে তারা ভেটো প্রয়োগ না করায় প্রস্তাবটি সহজেই গৃহীত হয়।
এই প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রণীত ২০ দফার গাজা পরিকল্পনাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৈধতা দেওয়া, যার অংশবিশেষ গত মাসে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির ভিত্তি তৈরি করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তাবের পক্ষে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল, আর অনুমোদনের পর প্রেসিডেন্ট এটি সামাজিক মাধ্যমে দীর্ঘ বার্তায় স্বাগত জানান। তিনি লেখেন, বিশ্ব নেতৃত্বের অংশগ্রহণে গঠিত হতে যাওয়া “বোর্ড অব পিস” বিশ্ব শান্তির নতুন অধ্যায় রচনা করবে।
খসড়া অনুযায়ী, প্রস্তাবটি গাজায় একটি অতির transitional কর্তৃপক্ষ হিসেবে “বোর্ড অব পিস” প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয় এবং একই সঙ্গে একটি অস্থায়ী আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী বা আইএসএফ গঠনের অনুমতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জানান, বোর্ড সদস্যদের পরিচয়সহ আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাগুলো আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ করা হবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, জাতিসংঘের অনুমোদন পাওয়ায় আইএসএফ-এ বিভিন্ন দেশ অংশগ্রহণের ভিত্তি এখন আরও সুদৃঢ় হলো। যুক্তরাষ্ট্রের জাতিসংঘ প্রতিনিধি জানান, মুসলিম-প্রধান কয়েকটি দেশসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের অংশগ্রহণে শক্তিশালী শান্তিরক্ষী জোট গাজায় একক কমান্ডের অধীনে কাজ করবে। তাদের দায়িত্ব হবে গাজার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নিরস্ত্রীকরণ প্রক্রিয়া তদারকি, বেসামরিক মানুষের সুরক্ষা এবং নিরাপদ করিডোর দিয়ে সহায়তা পৌঁছানো।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তারা আগেই বলেছিলেন, গাজা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি আন্তর্জাতিক ম্যান্ডেট প্রয়োজন। ভোটের আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সতর্ক করেন, প্রস্তাবের বিরোধিতা মানে আবার যুদ্ধের দিকে ফিরে যাওয়া।
তবে প্রস্তাব গৃহীত হলেও বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। পশ্চিমা কূটনৈতিক মহল জানিয়েছে, খসড়ায় সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বা বিস্তারিত রোডম্যাপ না থাকায় বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে ট্রানজিশনাল কর্তৃপক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি অস্পষ্ট; সেখানে শুধু বলা হয়েছে, সংস্কার কর্মসূচি সন্তোষজনকভাবে সম্পন্ন হলে দায়িত্ব হস্তান্তর হবে। বোর্ড অব পিস ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক উপস্থিতির মেয়াদ ২০২৭ সালের শেষ পর্যন্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবে হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠীর নিরস্ত্রীকরণের দায়িত্ব বোর্ড অব পিসের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে, যা ইসরায়েলের মূল দাবি। একই সঙ্গে গাজার পুনর্গঠনের বিষয়টিও তাদের অধীনে থাকবে। খসড়ায় ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথাও উল্লেখ রয়েছে, যদিও কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি।
রাশিয়ার প্রতিনিধি সতর্ক করে বলেন, এ প্রস্তাব যেন দুই রাষ্ট্র সমাধানের অন্তরায় না হয়। চীনের প্রতিনিধি মনে করেন, প্রস্তাবটিতে ফিলিস্তিনের ভূমিকা ও সার্বভৌমত্ব যথেষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
হামাস প্রস্তাবটিকে গাজায় আন্তর্জাতিক অভিভাবকত্ব চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। ভোটের পর তাদের অবস্থান আরও কঠোর হয় এবং গাজায় আন্তর্জাতিক বাহিনীর যে কোনো ভূমিকা সংঘাতকে নতুন দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে মত দেয়। গাজার সাধারণ মানুষের মাঝেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। ৩৮ বছর বয়সী এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, নতুন বাহিনী এলেও কাজের মান আগের অভিজ্ঞতার মতো হলে মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেতে পারে।
প্রস্তাব পাস হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জানান, বোর্ড অব পিস মানবিক সহায়তা সমন্বয় করবে, গাজার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে এবং একটি প্রযুক্তিনির্ভর কমিটি দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রমে সহায়তা করবে, যতক্ষণ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সংস্কার সম্পন্ন না করছে।
হামাসের কিছু অংশ এখনও নিরস্ত্রীকরণে অনড় নয়। পাশাপাশি গাজায় প্রতিশোধমূলক হামলার আশঙ্কায় তাদের যোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণে অনীহাও রয়ে গেছে। অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, গাজা অবশ্যই নিরস্ত্রীকৃত হবে, তা সহজ পথে হোক বা কঠিন পথে। ইসরায়েলের রাষ্ট্রপতি প্রস্তাবটিকে ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং ভবিষ্যতে শান্তির সম্ভাবনা দেখার আশাবাদ প্রকাশ করেছেন।



