ইউরোপের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি বর্তমানে জটিল বৈশ্বিক বাস্তবতার মুখোমুখি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্য নীতি এবং চীনের প্রতিযোগিতা যে প্রবল চাপ তৈরি করছে তা সামলাতে গিয়ে দেশটি টানা স্থবিরতার দুঃশ্চিন্তায় ডুবে আছে। গত মার্চে, দীর্ঘ মাসব্যাপী উদ্বেগের পর ইউরোপের বাজারে এক ঝলক আশার আলো দেখা দিয়েছিল। কারণ ছিল জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত অবস্থায় থাকা বর্তমান চ্যান্সেলরের একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। তিনি দেশের সাংবিধানিক ব্যয় সীমা শিথিল করার উদ্যোগ নেন যা অনেকের মতে ইউরোপের শক্তিশালী অর্থনীতিকে আবার গতিশীল করতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারত।
তবে ছয় মাস না যেতেই সেই আশাবাদ ম্লান হয়ে এসেছে। চ্যান্সেলরের পরিকল্পনায় ছিল দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে বৃহৎ বাজেট বরাদ্দ এবং অবকাঠামো ও সবুজ রূপান্তরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি ইউরো বিনিয়োগ। উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন নির্ভরতা কমিয়ে ইউরোপের নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখা এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা। কিন্তু গত সপ্তাহে তার অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা ২০২৬ সালের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস নামিয়ে ১ শতাংশের নিচে নিয়ে আসেন। এতে স্পষ্ট হয় যে প্রায় চার বছর ধরে যে স্থবিরতা চলছিল তা এখনো কাটার কোনো লক্ষণ নেই। ফলে ব্যবসায়ী মহলে আস্থাহীনতা বেড়েছে।
জার্মানির দীর্ঘদিনের কাঠামোগত সমস্যাগুলো রাতারাতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয় এটি আগেই জানা ছিল। বিশেষ করে দেশের দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থা পুনর্গঠনের সুফল পেতে আরও সময় লাগবে। কিন্তু ইউরোপের ভোটাররা এখন ধৈর্য হারাচ্ছেন। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক ধসের পর থেকে তাদের জীবনমান স্থবির বা অবনতিশীল বলে যারা মনে করেন তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, জার্মান জনগণের পাঁচভাগের একভাগেরও কম আবারও বর্তমান চ্যান্সেলরকে পরবর্তী নির্বাচনে দেখার পক্ষে।
এমন হতাশার সুযোগে ডানপন্থী এএফডি দল শীর্ষে উঠে এসেছে। এটি শুধু চ্যান্সেলর এবং তার মধ্য-ডান নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের জন্য নয় বরং ইউরোপের প্রচলিত রাজনীতির জন্য বড় হুমকি। রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ, চীনের আক্রমণাত্মক প্রতিযোগিতা এবং সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্য নীতি ইউরোপের রপ্তানিনির্ভর অর্থনৈতিক মডেলকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমান চ্যান্সেলর বুঝতে পেরেছিলেন যে এই অস্বাভাবিক সময়ের জন্য প্রয়োজন সাহসী আর্থিক পদক্ষেপ। কিন্তু জনঅসন্তোষ বাড়ার সাথে সাথে এখন তিনি সমালোচনার মুখে এবং সামাজিক ব্যয় কমানোর দাবি উঠছে প্রতিযোগিতা বাড়ানোর অজুহাতে।
চ্যান্সেলর একসময় বৈশ্বিক আর্থিক খাতের একটি বড় প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক বোর্ডে কাজ করেছেন এবং রাজনীতিতে আর্থিক কঠোরতার পক্ষে পরিচিত ছিলেন। তাই সামাজিক ব্যয় সংকোচনের আহ্বান তার পুরনো অবস্থানে ফেরত যাওয়ার মতো মনে হচ্ছে। যদিও তার জোটসঙ্গী সামাজিক গণতান্ত্রিক দল এই প্রবণতা ঠেকাতে পেনশন সংস্কার নিয়ে বিদ্রোহের চেষ্টা থামানোর উদ্যোগ নিচ্ছে, তবুও ডানপন্থী মহলের চাপ ক্রমেই বাড়ছে।
জার্মানির সামনে এখন যে চ্যালেঞ্জ, তার উত্তরে পুরনো অর্থনৈতিক নীতিতে ফিরে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। ইউরোপের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আবারও শক্তিশালী করা এবং নতুন বহুমুখী বৈশ্বিক বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়াতে বিনিয়োগ বাড়ানোই যে জরুরি তা স্পষ্ট। অতীতের ব্যর্থ নীতি অনুসরণ করলে শুধু ডানপন্থী উত্থানই ত্বরান্বিত হবে যা ২০০৮ পরবর্তী মিতব্যয়ী নীতির সময় থেকেই গতি পেতে শুরু করে।
চ্যান্সেলরের প্রথম ছয় মাস কঠিন ছিল। কিন্তু ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতির সামনে যত বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, জার্মানির আর পিছনে ফেরার সুযোগ নেই।



