ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই নানা ওঠানামার মধ্য দিয়ে চলছে। বিশেষ করে দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যঘাটতি এমন এক বিষয়, যা বারবার আলোচনায় এসেছে এবং একটি টেকসই বাণিজ্যচুক্তি বাধাগ্রস্ত করেছে। এ পরিস্থিতিতেই এবার এলপিজি ও এলএনজি আমদানিকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেতে চলেছে। ভারতের জ্বালানি আমদানি–ব্যবস্থায় বৈচিত্র্য আনার পাশাপাশি বাণিজ্যঘাটতি কিছুটা কমানোই এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য।
সম্প্রতি ভারতের জ্বালানি–সংশ্লিষ্ট এক মন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানির বিষয়ে একটি নতুন কাঠামোগত চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। এ চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ভারত তার মোট এলএনজি আমদানির প্রায় ১০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে নেবে। এক সামাজিক মাধ্যম–পোস্টে মন্ত্রী জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলো এক বছরের জন্য ২২ লাখ টন এলপিজি আমদানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, এটি দুই দেশের মধ্যে ‘প্রথম কাঠামোগত’ এলপিজি চুক্তি এবং ভবিষ্যতের জ্বালানি সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
জ্বালানিবিশেষজ্ঞদের মতে, ভারত এতদিন মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর এলপিজি আমদানির ওপর ভরসা করে এসেছে। কিন্তু ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন, সরবরাহ–নিরাপত্তা এবং মূল্য ওঠানামা বিবেচনায় এখন দেশটি উৎসবৈচিত্র্যে গুরুত্ব দিচ্ছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত কমানোও ভারতের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে দেশটি প্রতিবছর ২০–২১ মিলিয়ন টন এলপিজি আমদানি করে থাকে। এর ১০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনতে গেলে ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার, যা সামগ্রিক বাণিজ্যঘাটতিতে খুব বড় পরিবর্তন আনবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বর্তমান বাণিজ্য উদ্বৃত্ত প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের নীতির কারণে ভারতীয় পণ্যের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্কও দুই দেশের বাণিজ্যসম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। বর্তমানে ভারতীয় পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্কের হার ৫০ শতাংশ, যার মধ্যে ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক এবং বাকি ২৫ শতাংশ রাশিয়া থেকে তেল কেনার ‘শাস্তিমূলক’ শুল্ক হিসেবে ধার্য। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একাধিক দফা সমালোচনা ও পাল্টা মন্তব্যও হয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের অবস্থানে কিছুটা নরম ভাব দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা ভারতীয় নেতৃত্বকে “ঘনিষ্ঠ অংশীদার” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, এবং জ্বালানি–বাণিজ্য বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথাও জানিয়েছেন। যদিও রাশিয়া থেকে ভারত তেল আমদানি কমিয়েছে—এমন দাবি করা হলেও আন্তর্জাতিক জ্বালানি পর্যবেক্ষকদের তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত এখনো প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল রাশিয়া থেকে আমদানি করছে এবং নভেম্বর মাসে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে, ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকেও তেল আমদানি বাড়িয়েছে। অক্টোবর মাসে দেশটি দৈনিক ৬৮ হাজার ব্যারেল তেল আমদানি করেছে, যা ২০২১ সালের পর সর্বোচ্চ। একাধিক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকের মতে, রাশিয়ার বিশেষ ছাড় কমে যাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক চাপ—এই দুই কারণেই ভারত ভবিষ্যতে রাশিয়া–নির্ভরতা কমিয়ে তেল আমদানির উৎস বৈচিত্র্যমুখী করবে। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়া থেকে আমদানির হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমে ১৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তির (বিটিএ) প্রথম ধাপ সইয়ের সম্ভাবনা এখন খুবই কাছাকাছি। ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে, চুক্তির দুটি অংশ—একটি দীর্ঘমেয়াদি আলোচনা–নির্ভর, অন্যটি পারস্পরিক শুল্কসংক্রান্ত প্যাকেজ। শুল্ক–সমাধানধর্মী এ প্যাকেজটি প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এবং এটি কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ২৫ শতাংশ শাস্তিমূলক শুল্ক সমস্যারও সমাধান হতে পারে। প্রথম ধাপ শেষ হলেই দুই দেশের বাণিজ্য–সম্পর্কে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।



