ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ডানপন্থী শক্তির উত্থান নতুন কোনো ঘটনা নয়, তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সেই প্রবাহকে আরও দৃশ্যমান করে তুলেছে। দীর্ঘদিন ধরে মূলধারার রাজনীতি যে প্রতিরোধের দেয়াল তৈরি করে রেখেছিল, তা এখন নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ফ্রান্সে ডানপন্থী রাজনীতিকে ঠেকাতে যে ঐতিহ্যগত বাধা কার্যকর ছিল, তা ক্রমেই দুর্বল দেখাচ্ছে, এবং এ প্রবণতা গোটা ইউরোপীয় রাজনীতির জন্য উদ্বেগজনক।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ফ্রান্সের এক ডানপন্থী রাজনৈতিক সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে ডান ও কেন্দ্র-ডানের ঐক্যের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ডানপন্থী শক্তিকে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে রূপ দিতে হলে ঐক্য প্রয়োজন, এবং ফ্রান্সও একসময় এমন অবস্থায় পৌঁছাবে বলে তিনি আশা করছেন।
ইতালিতে তাঁর নেতৃত্বে ডানপন্থী রাজনীতির বিস্তার একটি বাস্তব উদাহরণ। যুদ্ধোত্তর সময়ের নব্য-ফ্যাসিবাদী ধারা থেকে উঠে আসা তাঁর দল মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রান্তিক অবস্থান থেকে জাতীয় রাজনীতির শীর্ষে উঠে এসেছে। একসময় যেখানে তাদের ভোট ছিল মাত্র কয়েক শতাংশ, এখন সেখানে তারা জাতীয় জরিপে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে। কেন্দ্র-ডানের অন্য দলগুলো সেখানে অনেকটাই পেছনে পড়ে গেছে।
ফ্রান্সে পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। বহু বছর ধরে কেন্দ্র-ডান ও বামপন্থী ভোটাররা মিলেই ডানপন্থী চরমপন্থার বিস্তার ঠেকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই প্রতিরোধ দুর্বল দেখাচ্ছে। কেন্দ্র-ডানের দল তাদের জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় এমন সব রাজনৈতিক বার্তা দিচ্ছে, যা ডানপন্থী উত্থানকে পরোক্ষভাবে উৎসাহ দিচ্ছে।
সম্প্রতি ফরাসি সংসদে প্রথমবারের মতো এমন একটি ঘটনা ঘটে, যেখানে অভিবাসন–সম্পর্কিত একটি প্রস্তাবে ডানপন্থীদের সঙ্গে কেন্দ্র-ডান দল একসঙ্গে ভোট দেয়। এটি ছিল ফ্রান্সের রাজনৈতিক চলার পথে এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত। একইসাথে কেন্দ্র-ডানের বেশ কিছু প্রভাবশালী নেতা এখন প্রকাশ্যে বলছেন, দেশে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক হুমকি নাকি বামপন্থী রাজনীতি। তাদের এই বক্তব্যকে সমর্থন দিচ্ছে দেশের বড় একটি মিডিয়া গ্রুপ, যারা দীর্ঘদিন ধরেই এই ধরনের রাজনৈতিক বয়ানকে প্রচার করে যাচ্ছে।
ইউরোপের অন্য দেশগুলোর চিত্রও একই ধরনের। নেদারল্যান্ডসে নতুন সরকার গঠনের আলোচনায় কেন্দ্র-ডান দল প্রকাশ্যে জানিয়েছে যে তারা ডানপন্থী দলের সঙ্গে জোট গঠনে আপত্তি দেখছে না। জার্মানির পূর্বাঞ্চলে স্থানীয় পর্যায়ে কেন্দ্র-ডান দল এবং চরম ডানপন্থী দলের সহযোগিতা এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টেও এই প্রবণতা দেখা গেছে। জলবায়ু–সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন দুর্বল করার জন্য সাম্প্রতিক ভোটে কেন্দ্র-ডান সদস্যরা ডানপন্থীদের সাথে হাত মিলিয়েছেন—যা এর আগে কখনো ঘটেনি। পরিবেশ বিষয়ক এক সদস্য এই ঘটনাকে ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক সংকেত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ইউরোপে অথবা যুক্তরাষ্ট্রে—রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, ডানপন্থাদের দাবি মেনে নেওয়ার ফলে সাধারণত মূলধারার দলগুলো লাভবান হয়নি। বরং উল্টো ডানপন্থার চাহিদা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মধ্যপন্থী রাজনীতি দুর্বল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এমন উদাহরণ খুবই স্পষ্ট, যেখানে মধ্যপন্থী রাজনীতি চরমপন্থার সঙ্গে আপস করতে গিয়ে নিজেই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
এখন ফ্রান্সে ২০২৭ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্র-ডানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ডানপন্থী শক্তির দিকে ঝুঁকছে। এটা শুধু তাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের জন্যই নয়, বরং গোটা ইউরোপের মূলধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্যও দুঃখজনক ও হতাশাজনক।



