ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের সাম্প্রতিক চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। পূর্বাঞ্চলীয় পোক্রোভস্ক শহরের দিকে রুশ সেনারা যখন ঘন কুয়াশা ভেদ করে এগোতে থাকে, সেটি যেন এক পরাবাস্তব দৃশ্যের মতো—কেউ মোটরসাইকেল, কেউবা মপেডে চড়ে; কেউ ভাঙাচোরা পিকআপের পেছনে দাঁড়িয়ে; আবার দলছুট কিছু সেনা চলেছে খাঁচা-সদৃশ যন্ত্র লাগানো বিশেষ যান ব্যবহার করে। অদ্ভুত এই চলমান চিত্রটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও থেকে পাওয়া, যা পোক্রোভস্কের অদূরে ধারণ করা বলে যাচাই করা হয়েছে।
পোকারভস্কের যুদ্ধ—নতুন প্রতীক, নতুন কৌশল
বাখমুত দখলের পর যদি রাশিয়া পোক্রোভস্ক নিয়ন্ত্রণে নেয়, তাহলে এটি হবে মস্কোর সর্ববৃহৎ সাফল্য। শহরটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও, এটি হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের প্রতীক। একই কারণে রুশ নেতৃত্ব যেকোনো মূল্যে এটিকে দখল করতে চাইছে, আর ইউক্রেনীয় বাহিনী মরিয়া হয়ে তা রক্ষা করতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে বাখমুতের যুদ্ধের তুলনায় এখানে রাশিয়ার সামরিক কৌশল স্পষ্টভাবে বদলে গেছে। গত দুই বছরে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ড্রোন ব্যবহারের ফলে ফ্রন্টলাইনের দুই পাশে ‘কিল জোন’ বা মারাত্মক আঘাতের এলাকা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। ফলে প্রচলিত ভারী ট্যাংক বা সাঁজোয়া যান দ্রুত অগ্রসর হতে পারছে না। এর পরিবর্তে রুশ সেনারা এখন হালকা, দ্রুতগতি সম্পন্ন যান—মপেড, বাগি, মোটরসাইকেল ইত্যাদি দিয়ে ইউক্রেনীয় অবস্থানে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।
ড্রোন-নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধক্ষেত্রের চাপ
ইউক্রেনের ১২৯তম ব্রিগেডের এক সদস্য জানান, বাগিতে রুশ সেনাদের এগিয়ে আসা তাদের কাছে প্রথমে অপ্রত্যাশিত লাগলেও পরে তা যৌক্তিক মনে হয়—কারণ ড্রোনের আঘাত এড়াতে হালকা যান দ্রুত সরে যেতে সাহায্য করে। রুশ বাহিনীর প্রায় ৩০০ সৈন্য বর্তমানে পোক্রোভস্কের ভেতরে রয়েছে বলে ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা দপ্তর জানায়।
চিকিৎসা সহায়তা প্রায় অসম্ভব
রাশিয়া দুই বছর ধরে পোক্রোভস্কের দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। শহরটিকে ঘিরে ফেলার প্রচেষ্টা এতটাই তীব্র যে আহত সৈন্যদের সরানো এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনীয় চিকিৎসাকর্মীরা জানাচ্ছেন, চিকিৎসা নেওয়ার আগেই অনেক আহত মারা যাচ্ছে। গুরুতর আহতদের মধ্যে কেউ কেউ আঘাত পাওয়ার পর দুই সপ্তাহ ধরে একই স্থানে পড়ে আছে, কিন্তু ড্রোন হামলার ঝুঁকিতে তাঁদের উদ্ধার করা যাচ্ছে না। মানবিক বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা যানবাহন লক্ষ্য করে হামলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
‘মিট গ্রাইন্ডার’ থেকে ছোট দল—রুশ কৌশলে বড় পরিবর্তন
২০২৩ সালে বাখমুতের লড়াইয়ে রুশ বাহিনী তরঙ্গের মতো একের পর এক সৈন্য পাঠাত—যাকে ইউক্রেনীয়রা বলত ‘মিট গ্রাইন্ডার’ কৌশল। এতে বিপুল সংখ্যক রুশ সেনা হতাহত হলেও তারা সামনে এগোনোর পথ খুঁজে নিত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। রুশ বাহিনী এখন ছোট ছোট তিনজনের দল করে শহরে ঢোকার চেষ্টা করছে, যাতে ড্রোন নজর এড়ানো যায়। একজন হলেও অবস্থানে পৌঁছাতে পারলেই তারা সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসতে পারে—এমনটাই ধারণা।
ইউক্রেনীয় ড্রোন ইউনিটের এক সদস্য জানান, দিনে শতাধিক ছোট দল চেষ্টা করছে শহরে ঢোকার, যার মধ্যে বেশিরভাগই ধ্বংস হয়, কিন্তু কিছু দল অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে, রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে হতাহতের সংখ্যা ইতোমধ্যে ১১ লাখের বেশি বলে বিভিন্ন মূল্যায়নে উল্লেখ করা হয়েছে, যার এক-তৃতীয়াংশ এই বছরেই।
রাশিয়ার ধীর কিন্তু স্থির অগ্রগতির কারণ এ ধরনের কৌশলগত পরিবর্তন বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। দ্রুত অগ্রসর হওয়ার চেয়ে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে যুদ্ধক্ষেত্র দখল করাই এখন রুশ সামরিক নেতৃত্বের মূল লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে।



