সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাহিত্যভিত্তিক উপন্যাসের মূলধারা দখল করে নিয়েছিল নারীদের আত্মজগত ও মানসিক অভিজ্ঞতা। বহু লেখকের উপন্যাসে তরুণ নারীর অনুভব, সম্পর্ক, সংগ্রাম ও স্ব-চেতনার যে নতুন বর্ণনাশৈলী দেখা গেছে, তা পাঠকদের কাছে তাজা ও বাস্তব মনে হয়েছে। এই প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুরুষ অভিজ্ঞতা বা পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে এমন গভীর সাহিত্যিক বর্ণনা তুলনামূলকভাবে কমে গিয়েছিল—বিশেষ করে #MeToo আন্দোলনের সময়ের পর।
এমন প্রেক্ষাপটে এবারের বুকার পুরস্কার অর্জন করেছে একটি উপন্যাস, যেখানে পুরুষত্ব বা masculinity-কে নির্দ্বিধায় কেন্দ্রস্থলে রাখা হয়েছে। ‘Flesh’ নামের এই উপন্যাসে এক অভিবাসী তরুণের জীবনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে গভীর অথচ নির্মম বাস্তবতার গল্প। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র—এক শ্রমজীবী তরুণ—১৯৮০-এর দশকের শেষ দিক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ওঠানামার মধ্য দিয়ে যে পথ পাড়ি দেয়, তারই গল্প বলা হয়েছে। তাকে আমরা সবচেয়ে বেশি দেখি আকস্মিক সহিংসতা, স্বল্পস্থায়ী সম্পর্ক বা একঘেয়ে দৈনন্দিন কাজে। চরিত্রটি খায়, ধূমপান করে, একই ধরনের সংলাপ বারবার বলে—কিন্তু তার ভেতরের আবেগ, অনুভূতি বা দর্শন সম্পর্কে পাঠক খুব কমই কিছু জানতে পারে। লেখকের উদ্দেশ্যই ছিল এই—প্রচলিত বাস্তবধর্মী উপন্যাসকে একেবারে নিঃসাড় ভঙ্গিতে তুলে ধরা।
বুকার পুরস্কার গ্রহণের সময় লেখক বলেন, এই উপন্যাসে তিনি নানান দিক থেকে ঝুঁকি নিয়েছেন—রূপগত, নান্দনিক এবং নৈতিক। বিশেষ করে পুরুষ দৃষ্টিকোণ থেকে যৌনতা নিয়ে সরাসরি লেখার বিষয়টি যে এখনকার সময়ে কঠিন, সেটিও তিনি উল্লেখ করেন। অতীতে কিছু লেখক যেভাবে পুরুষত্বকে কেন্দ্র করে সাহিত্য নির্মাণ করেছেন, বর্তমান সময়ে সেই ভাষা বা ভঙ্গি গ্রহণযোগ্য নয়। তবুও আকাঙ্ক্ষা, সম্পর্ক বা শারীরিকতার গল্প বলা সাহিত্য থেকে হারায়নি—বরং নারী লেখকেরা তা দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। কিন্তু পুরুষ লেখকদের জন্য এই ক্ষেত্রটি অনেকটাই নিষিদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এই উপন্যাস প্রমাণ করল—এখনও সাহসী ও দায়িত্বশীল ভঙ্গিতে পুরুষ দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা সম্ভব।
এই লেখক পুরুষ-অহংকারভিত্তিক সাহিত্যের পুরনো ধাঁচের বদলে বেছে নিয়েছেন নিরাবেগ, সরল ও পর্যবেক্ষণ-নির্ভর বাস্তবতা। উপন্যাসজুড়ে মূল চরিত্রটিকে খুব বেশি বার অবজেক্টিফাই বা মূল্যায়ন করা হয়, এবং শক্তির অবস্থান প্রায়ই দেখা যায় নারীদের হাতে। কিছু অংশে কিশোর বয়সের এক ছেলের উপর বয়স্ক নারীর অনৈতিক আচরণ তুলে ধরা হয়েছে—যে বিষয়টি সাহিত্য জগতে খুব কমই আলোচিত হয়। উপন্যাসে দেখা যায়, এমন অভিজ্ঞতা কীভাবে প্রধান চরিত্রের পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করে, পাশাপাশি সময়ের বাস্তবতা, রাজনীতি, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও ইতিহাস কীভাবে তার জীবনে প্রভাব ফেলে।
অভিবাসন, অর্থনীতি, পুরুষত্ব এবং পরিচয় সংকট—এই চারটি প্রধান বিষয়ে ভিত্তি করে উপন্যাসটি সময়ের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছে। লেখক দেখিয়েছেন, “ইনসেল কালচার” বা বর্তমান সময়ের পুরুষ পরিচয় সংকট নতুন নয়; বহু আগে থেকেই তরুণ ও পুরুষরা পরিচয়, উদ্দেশ্য এবং অস্তিত্বগত প্রশ্নে লড়াই করে এসেছে। উপন্যাসের একলাইন দীর্ঘ অনুচ্ছেদগুলো আধুনিক পাঠকের মনোযোগের স্বল্পতার প্রতীক হলেও, মোট কাঠামোতে এটি মহাকাব্যের মতো বিস্তৃত। কারণ, এখানে মূল প্রশ্নটি বৃহৎ—মানুষ হওয়া মানে কী?
গত বছরের বুকারজয়ী যে উপন্যাস মানবজাতিকে বিস্ময়করভাবে পৃথিবীর বাইরে তাকাতে উৎসাহ দিয়েছিল, এবারের উপন্যাসটি পাঠককে ফিরিয়ে এনেছে শরীরের অন্তর্গত বাস্তবতায়—মানুষের অস্তিত্ব আসলে কতখানি ভঙ্গুর, কতখানি কঠিন, এবং একই সঙ্গে কতটা জীবন্ত—সেই প্রশ্ন তুলেছে। মানুষের লিঙ্গ-পরিচয় দিয়ে সাহিত্যকে বিচার করা কতটা সীমাবদ্ধ হতে পারে, তাও এই কাজটি স্পষ্ট করে। কারণ, পড়া মানে শেষ পর্যন্ত অন্য কারও জীবনের ভেতরে সাময়িকভাবে প্রবেশ করা।



