বাল্টিক সাগরের তীরে সেই ভোরের চমকপ্রদ রাতটি আজও ইউরোপের মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। একের পর এক মৃদু বিস্ফোরণ এবং সাগরের পৃষ্ঠে বুদবুদ ভেসে উঠার দৃশ্য সেই রাতের স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। রাশিয়ার দুটি নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইন, যা ইউরোপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি সরবরাহের ধারা ছিল, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের রাতে ধ্বংস হয়। এটি ঘটেছে রাশিয়ার ইউক্রেইনে পূর্ণ আক্রমণের কয়েক মাস পরে।
বিস্ফোরণের কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রাতের ঢেউ ইউরোপ জুড়ে তীব্র উত্তেজনা তৈরি করেছে। এই হামলা আন্তর্জাতিকভাবে “হুডানিট” হিসেবে দেখা হয়েছে, যেখানে অবিলম্বে রাশিয়ার দিকে সন্দেহের আঙুল উঠে এবং এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকেও সরাসরি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় বলে ঘোষণা দিতে হয়েছে।
আজও সেই বিস্ফোরণ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে, জার্মানি ইউক্রেনীয় সন্দেহভাজন দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে প্রস্তুত। তবে পোল্যান্ডের এই মামলার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করার প্রচেষ্টা – সম্ভবত তাদের মিত্র ইউক্রেনকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য – ইউরোপের মধ্যে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।
জার্মানি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে নর্ড স্ট্রিম মামলার বিচার কার্যকর হবে। তারা দুটি ইউক্রেনীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি ও ওয়্যারেন্ট জারি করেছে। একজনকে পোল্যান্ডে আটক করা হয়েছে, আরেকজনকে ইতালিতে। অভিযোগ রয়েছে, তারা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বর্নহোমের দ্বীপের কাছে পাইপলাইনে বিস্ফোরক স্থাপন করেছিলেন। জার্মান প্রসিকিউটররা উল্লেখ করেছেন, সন্দেহভাজন একজন “প্রশিক্ষিত ডাইভার” এবং অপরজন প্রাক্তন ইউক্রেনীয় সেনা হিসেবে অভিযোগের সঙ্গে যুক্ত।
পোলিশ আদালতের এক সিদ্ধান্তে একজনকে জার্মানিতে প্রত্যর্পণ না করার আদেশ দেওয়া হয়। বিচারকের মতে, যদি নর্ড স্ট্রিম বিস্ফোরণ সত্যিই ইউক্রেনীয়দের পরিকল্পিত হামলা হয়ে থাকে, তবে এটি একটি যথাযথ প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে।
এই মামলার বিষয়টি শুধু জার্মানির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং পুরো ইউরোপের নিরাপত্তা ও নীতিনির্ধারণের প্রেক্ষাপটে তা গুরুত্ব বহন করছে। হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং লিথুয়ানিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, পাইপলাইনের অস্তিত্ব এবং এই হামলার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো ইউরোপের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে।
ডেনমার্ক ও সুইডেন – যেখানে পাইপলাইনটি গেছে – এই বিস্ফোরণ সংক্রান্ত মামলা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুইডেন জানিয়েছে, তাদের এখতিয়ার নেই। তবে জার্মানি মামলা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বিশ্লেষকরা মনে করেন, এটি দেশের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যেখানে দেশীয় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ চলছে।
নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন ইউরোপের জ্বালানি নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। ২০১৬ সালে জার্মানির প্রায় ৩০% গ্যাস চাহিদা রাশিয়ার পাইপলাইন থেকে পূরণ হতো। তবে ২০২২ সালের ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণ আক্রমণের পর এই নির্ভরতা ধ্বংস হয়ে যায়। ২০২১ সালে রাশিয়ার গ্যাসের ইউরোপে সরবরাহ ছিল ৪০%-এর বেশি, যা ২০২৪ সালে কমে মাত্র ১১%-এ দাঁড়ায়।
এই ঘটনায় শুধু বিচার প্রক্রিয়া নয়, ইউরোপের দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নীতি এবং নিরাপত্তা পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও উঠে এসেছে। পাইপলাইন ধ্বংসের ফলে রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরতা কমানো হয়েছে এবং ইউরোপ নিজস্ব জ্বালানি নিরাপত্তা স্থাপন করতে শুরু করেছে।
এটি দেখিয়েছে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং শক্তির প্রতিযোগিতার মধ্যে কেবল একটি বিস্ফোরণও বহু বছর ধরে অঞ্চলের নীতিগত এবং কূটনৈতিক প্রভাব রাখতে পারে। ইউরোপের দেশগুলোর জন্য এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, নর্ড স্ট্রিম হামলার মতো ঘটনা আবার না ঘটে এবং ভবিষ্যতে জ্বালানি নিরাপত্তা ও আইনগত প্রক্রিয়া আরও দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করা।



