এক সময় হাম-মুক্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া কানাডা এবার সেই মর্যাদা হারিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্যান আমেরিকান হেলথ অর্গানাইজেশন (PAHO) জানিয়েছে, টানা ১২ মাস ধরে দেশে হাম ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ায় কানাডা আর হাম-মুক্ত দেশের তালিকায় নেই।
এর ফলে আমেরিকা মহাদেশের সামগ্রিক হাম-মুক্ত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি বাতিল হয়েছে, যদিও অন্যান্য দেশগুলো এখনও পৃথকভাবে হাম নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রও এখন একই ঝুঁকিতে রয়েছে—চলমান প্রাদুর্ভাব যদি আগামী জানুয়ারির মধ্যে নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে দেশটিও তাদের হাম-মুক্ত অবস্থান হারাতে পারে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ, অ্যারিজোনা এবং সাউথ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্যে নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
কানাডায় এই প্রাদুর্ভাব শুরু হয় গত বছরের অক্টোবর মাসে। দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টিকাদান হারের ঘাটতির কারণেই এই সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে PAHO কর্তৃপক্ষ কানাডার সরকার ও সাধারণ জনগণকে টিকাদান কর্মসূচি জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটির মতে, হাম সংক্রমণ রোধে কমপক্ষে ৯৫ শতাংশ জনগণের টিকাদান সম্পন্ন হওয়া জরুরি।
PAHO–এর পরিচালক বলেন, “এই মর্যাদা হারানো নিঃসন্দেহে একটি ধাক্কা, তবে এটি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। পর্যাপ্ত টিকাদান ও সচেতনতা বাড়াতে পারলে কানাডা আবার হাম-মুক্ত অবস্থানে ফিরে যেতে পারবে।”
কানাডার জনস্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, তারা বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করছে টিকাদান হার বাড়াতে এবং তথ্য আদান–প্রদান শক্তিশালী করতে। উল্লেখযোগ্য যে, এই মর্যাদা হারানোর আগে কানাডা তিন দশক ধরে হাম-মুক্ত দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এনে পরবর্তী ১২ মাসে নতুন কোনো প্রাদুর্ভাব না ঘটলে দেশটি পুনরায় হাম-মুক্ত মর্যাদা ফিরে পেতে পারে।
২০২৫ সাল জুড়ে কানাডায় ৫,০০০–এরও বেশি হাম আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে, যার বেশিরভাগই অন্টারিও ও আলবার্টা প্রদেশে। তুলনামূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে একই সময়ে ১,৬৮১টি আক্রান্তের ঘটনা পাওয়া গেলেও কানাডার জনসংখ্যা অনেক কম হওয়ায় সংক্রমণের হার সেখানে অনেক বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অধিকাংশ সংক্রমণ ঘটছে এমনসব এলাকায়, যেখানে টিকাদানের হার অত্যন্ত কম। আলবার্টা প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলে দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে মাত্র ৬৮ শতাংশ হাম টিকা পেয়েছে, যা ৯৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক কম।
বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, হাম প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর হলো MMR ভ্যাকসিন, যা হাম, মাম্পস এবং রুবেলা—এই তিন ভাইরাসের বিরুদ্ধে ৯৭% পর্যন্ত সুরক্ষা প্রদান করে। তবে কানাডায় টিকাদান হার কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে নানা কারণ—পারিবারিক চিকিৎসকের অভাব, জাতীয় টিকাদান রেজিস্ট্রির অনুপস্থিতি, ভুল তথ্যের প্রচার এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার ঘাটতি।
একজন কানাডীয় ইমিউনোলজিস্টের মতে, “আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিভিন্ন জায়গায় দুর্বলতা ও ভুল ব্যবস্থাপনার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা হওয়া উচিত।”
২০১৬ সালে আমেরিকা মহাদেশ প্রথমবারের মতো হাম-মুক্ত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। যদিও ভেনেজুয়েলা ও ব্রাজিলে পরবর্তী সময়ে বড় আকারে প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় সেই মর্যাদা সাময়িকভাবে বাতিল হয়। ২০২৪ সালে আবারও টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে দুই দেশ হাম-মুক্ত অবস্থায় ফিরে আসে। কিন্তু বর্তমানে উত্তর আমেরিকায় নতুন করে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে, যার প্রভাব পড়ছে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো—এই তিন দেশেই।
মার্কিন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, মেক্সিকোও এখন বিশ্বের শীর্ষ দশটি হাম আক্রান্ত দেশের তালিকায় রয়েছে।



