বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্রমেই বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, বনাঞ্চলের আগুন—সব মিলিয়ে অনেক পর্যটন অঞ্চল বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর কত দ্রুত ভ্রমণকারীদের সেখানে যাওয়া উচিত?
সম্প্রতি শক্তিশালী এক ঘূর্ণিঝড় ক্যারিবীয় অঞ্চলের একটি দ্বীপকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। ঘূর্ণিঝড়টির আঘাতে দ্বীপটির প্রায় ৭২ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। এমন অবস্থায় দেশটির পর্যটন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা ডিসেম্বরের মধ্যভাগে পর্যটন মৌসুমে আবারও ভ্রমণকারীদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু এখনো হাজারো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন—এ অবস্থায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, এতো দ্রুত ভ্রমণ পুনরায় শুরু করা কতটা নৈতিক বা নিরাপদ?
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের দুর্যোগ এখন নিয়মিত ঘটছে এবং এর ফলে ভ্রমণকারীদের এখন শুধু “কখন নিরাপদ” নয়, বরং “কখন উপযুক্ত” সময়ে যাওয়া উচিত—তা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দুর্যোগ–পরবর্তী পর্যটন নিয়ে মূলত তিনটি প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি—
প্রথমত, আপনার ভ্রমণ কি স্থানীয় সমাজের জন্য সহায়ক নাকি বোঝা তৈরি করছে?
একটি দ্বীপে ২০১৭ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর মাত্র তিন মাসের মধ্যেই পর্যটকদের স্বাগত জানানো হয়েছিল। কিন্তু তখন অনেক স্থানীয় মানুষ এখনো বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছিলেন। ফলে স্থানীয়দের একাংশ পর্যটকদের উপস্থিতিতে বিরক্ত বোধ করেন। তারা মনে করেন, পর্যটন আয় বড় বড় রিসোর্ট বা বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যায়, অথচ স্থানীয়দের ভাগ্যে কিছুই জোটে না। তাই সচেতন পর্যটকদের উচিত দুর্যোগের পর স্থানীয় হোটেল, দোকান বা রেস্তোরাঁয় খরচ করা, যাতে তাদের অর্থ সরাসরি স্থানীয় অর্থনীতিতে যুক্ত হয়।
দ্বিতীয়ত, আপনি সাহায্য করছেন, নাকি শুধু দেখতে যাচ্ছেন?
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর বহু মানুষের মৃত্যু ও অগণিত বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছিল। এর পর কিছু ব্যবসায়ী শহরের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরিয়ে দেখানোর ট্যুর চালু করেন, যা স্থানীয়দের কাছে গভীরভাবে আঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরে প্রশাসন এসব ট্যুর বন্ধ করে দেয়। তবে একই সময়ে অনেক স্বেচ্ছাসেবক পর্যটক সেখানে গিয়ে ঘরবাড়ি পরিষ্কার, স্কুল মেরামত ও গির্জা পুনর্নির্মাণে হাত লাগান। তাদের এই “ভলান্ট্যুরিজম” বা সহায়তামূলক ভ্রমণ স্থানীয়দের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিল।
তৃতীয়ত, আপনি কি স্থানীয়দের মতামত শুনছেন?
সম্প্রতি প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঐতিহাসিক শহর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। তখন স্থানীয় প্রশাসন পর্যটকদের সাময়িকভাবে দ্বীপে প্রবেশ বন্ধ রাখে, যাতে জরুরি সহায়তা কেবল ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দিকেই দেওয়া যায়। প্রায় এক সপ্তাহ পর ধীরে ধীরে ভ্রমণ আবার শুরু হয়, তবে স্থানীয়রা সরাসরি সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। ধীরে ধীরে পর্যটকরা ফিরে এলেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ রাখা হয়, এবং সবাইকে স্থানীয়দের সহায়তায় অংশ নিতে উৎসাহিত করা হয়।
এই ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যায়—দুর্যোগের পর পর্যটন পুনরায় চালু করা শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়, এটি সামাজিক পুনর্গঠনেরও একটি অংশ। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্বচ্ছ তথ্য, স্থানীয়দের সম্মান, এবং এমনভাবে পর্যটন পুনরায় শুরু করা যাতে সেটি পুরো সমাজের পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়।
ভ্রমণকারীদের জন্য কিছু মূল পরামর্শ হলো—
দুর্যোগ–পরবর্তী অঞ্চলে যাওয়ার আগে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ তথ্য যাচাই করা, স্থানীয় ব্যবসায় ব্যয় করা, এবং স্থানীয়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা।
একজন পর্যটন বিশেষজ্ঞের ভাষায়—“দুর্যোগের পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তা কখনো মানুষের পুনরুদ্ধারের চেয়ে অগ্রাধিকার পেতে পারে না। মানুষ আগে, তারপর অর্থনীতি।”



