ব্রিটেনের গণমাধ্যমের অগ্রণী প্রতিষ্ঠান বিবিসি বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখে। সাম্প্রতিক সময়ে শীর্ষ পর্যায়ের পদত্যাগ ও রাজনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি যেন এক প্রকার ‘অপরাজেয় চ্যালেঞ্জ’ সম্মুখীন হয়েছে। বিস্তৃত রাজনৈতিক চাপ, বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং লেবার পার্টির অস্বস্তিকর অবস্থান বিবিসির স্বাধীনতা রক্ষার প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিবিসির চেয়ার পদে থাকা একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। তার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, বিবিসি এখন শুধুমাত্র নিজেকে পুনর্গঠনের চেষ্টায় নয়, বরং এক প্রকার চাপের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে টিম ডেভির পদত্যাগের পর নতুন ডিরেক্টর জেনারেল খোঁজা, এবং নিউজ বিভাগের সিইওর পদত্যাগ—সব মিলিয়ে এই সময়ে বিবিসির বোর্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ব্যস্ত।
বিবিসি বিশ্বের মধ্যে একটি অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পর্যটকরা এই প্রতিষ্ঠানের উপর ভরসা রাখেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানের প্রাসঙ্গিকতা এবং নাগরিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার মূলক লক্ষ্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কিছুটা দিকনির্দেশ হারিয়েছে। সেই সঙ্গে মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টদের প্রভাবও বিবিসিকে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি করেছে, যারা সত্যের পরিবর্তে উত্তেজনা ও বিতর্ককে আর্থিকভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।
বর্তমান বিতর্কের মূল উৎস হলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণের এডিট সংক্রান্ত ঘটনা। কিন্তু প্রকৃত লড়াইটি চলেছে ‘নিরপেক্ষতার’ সংজ্ঞা এবং কে তার সিদ্ধান্ত নেবে তা নির্ধারণের উপর। প্রচলিত সাংবাদিকতার মানে হলো যাচাইযোগ্য তথ্য ও নির্ভরযোগ্য সূত্রের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। অন্যদিকে, попুলিস্ট ডানপন্থীরা বিবিসিকে পক্ষপাতিত্বমূলক ও অতীতের প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে, তবে তাদের দেওয়া বিকল্প হলো বৃহৎ কর্পোরেট এবং অ্যালগরিদম-নির্ধারিত সংবাদ, যা তথ্যের নিরপেক্ষতার চেয়ে উগ্রতা প্রচার করে।
গত দশকে বিবিসির আয় প্রায় ৩০% হ্রাস পেয়েছে। তার পরও প্রতিষ্ঠানটি জনগণের জন্য অসাধারণ মানসম্মত সংবাদ পরিবেশন করছে। উদাহরণস্বরূপ, তাদের জনপ্রিয় শো “দ্য সেলিব্রিটি ট্রেইটারস” রেকর্ড ভাঙছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও স্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি নেই যে লাইসেন্স ফি ২০২৭ সালের পরও নিরাপদ থাকবে। যদি এটি নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে বিবিসি বাজারভিত্তিক মডেলে পরিণত হতে পারে, যা এর স্বাভাবিক জনসেবার চরিত্রকে হ্রাস করবে।
এমন সময়ে ট্রাম্পের কোটি ডলারের মামলা হুমকি আসে, যা বিবিসির জন্য একেবারে অপ্রত্যাশিত ও ক্ষতিকর মুহূর্ত। বোর্ডের অভিজ্ঞতা সীমিত, এবং রাজনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় তারা প্রস্তুত নয়। এদিকে, ট্রাম্পের ‘ফেক নিউজ’ প্রচারণা বৈশ্বিকভাবে বিবিসিকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে, যেমন তিনি মার্কিন প্রেসকে ভয় দেখিয়েছেন।
সাংবাদিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা হারালে তা কেবল একটি ঘটনার ভুল হিসেবে রয়ে যাবে না, বরং পুরো গণতান্ত্রিক কাঠামোতে প্রভাব ফেলবে। তাই রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারের উচিত বিবিসির স্বাধীনতা রক্ষা করা, যাতে প্রতিষ্ঠানটি সত্য প্রকাশের ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে পারে। একটি স্বতন্ত্র, নিরপেক্ষ ও নিরাপদ গণমাধ্যমের গুরুত্ব এখন জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
বিবিসির জন্য এই সংকট শুধুমাত্র একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; এটি ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তি ও বিশ্বস্ততার পরীক্ষা। দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর এখন একটাই প্রশ্নের দিকে: ব্রিটেন কি তার সত্য প্রকাশের শক্তি রক্ষা করতে পারবে?



