২০২৫ সালের বুকার পুরস্কারের মর্যাদাপূর্ণ আসরে জয়ী হয়েছেন হাঙ্গেরীয়-বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক ডেভিড সা-লাই। লন্ডনে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে তাঁর উপন্যাস ‘ফ্লেশ’ নির্বাচিত হয়েছে বছরের সেরা সাহিত্যকর্ম হিসেবে। এই উপন্যাসে উঠে এসেছে এক হাঙ্গেরীয় অভিবাসীর জীবনের গভীর সংগ্রাম—একজন মানুষ যিনি অর্থ উপার্জন করেন, আবার তা হারিয়েও ফেলেন।
৫১ বছর বয়সী এই লেখক ফাইনাল লিস্টে থাকা আরও পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে পেছনে ফেলে ৫০ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড (প্রায় ৬৫ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার) মূল্যের পুরস্কার জিতে নেন। এ বছর চূড়ান্ত তালিকায় ছিলেন ভারতের কিরণ দেশাই এবং যুক্তরাজ্যের অ্যান্ড্রু মিলারও।
সহজ ও সংক্ষিপ্ত ভাষায় লেখা ‘ফ্লেশ’ উপন্যাসটি মূলত ইস্তভান নামের এক মৌনস্বভাব পুরুষের জীবনকাহিনি। গল্প শুরু হয় তাঁর কৈশোরে, যখন তিনি নিজের চেয়ে বেশি বয়সী এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সেখান থেকে শুরু হয় জীবনের ভিন্ন অধ্যায়—অভিবাসী হিসেবে যুক্তরাজ্যে সংগ্রাম, এবং শেষ পর্যন্ত লন্ডনের উচ্চবিত্ত সমাজে তাঁর অবস্থান।
বুকার পুরস্কারের আয়োজকেরা এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘ফ্লেশ’ শ্রেণি, ক্ষমতা, অন্তরঙ্গতা, অভিবাসন এবং পুরুষত্ব নিয়ে এক গভীর ও চিন্তাশীল রচনা। এটি এমন এক ব্যক্তির গল্প, যার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতাগুলো তার পুরো জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
পুরস্কার গ্রহণকালে সা-লাই বলেন, “আমি চেয়েছিলাম এমন একটি উপন্যাস লিখতে যা ঝুঁকিপূর্ণ। বিচারকমণ্ডলী সেই প্রচেষ্টার স্বীকৃতি দিয়েছেন—এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ।” তিনি মুচকি হেসে আরও যোগ করেন, “আমি আমার সম্পাদককে একবার বলেছিলাম—আপনি কি কল্পনা করতে পারেন, ‘ফ্লেশ’ নামে কোনো উপন্যাস বুকার জিততে পারে? আজ সেই প্রশ্নের উত্তর আমি আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছি।”
বিজয়ীর পাশাপাশি চূড়ান্ত প্রার্থীদের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৫০০ পাউন্ড করে। এ পুরস্কার শুধু আর্থিক নয়, লেখকের খ্যাতি ও বইয়ের বিক্রির ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আনে।
বিচারকমণ্ডলীর সদস্য আয়ারল্যান্ডের লেখক রডি ডয়েল বলেন, “ফ্লেশ এমন এক বই, যা জীবনের অদ্ভুত দিকগুলো তুলে ধরে। পাঁচ ঘণ্টার আলোচনার পর বিচারকমণ্ডলী সর্বসম্মতিক্রমে একে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করে।” তিনি আরও বলেন, “আমি এমন কোনো উপন্যাস পড়িনি যেখানে লেখক পৃষ্ঠার সাদা জায়গাগুলো এত সুন্দরভাবে ব্যবহার করেছেন। যেন পাঠক নিজেই চরিত্রগুলো গড়ে তুলতে পারেন, নিজের মতো করে সেই গল্পে অংশ নিতে পারেন।”
ডয়েলের পাশাপাশি বিচারকমণ্ডলীতে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সারাহ জেসিকা পার্কারও।
হাঙ্গেরিতে জন্ম নেওয়া, যুক্তরাজ্যে বেড়ে ওঠা এবং বর্তমানে ভিয়েনায় বসবাসরত সা-লাই ২০১৬ সালে ‘অল দ্যাট ম্যান ইজ’ উপন্যাসের জন্য বুকারের ফাইনালিস্ট হয়েছিলেন। পৃথক নয়জন পুরুষ চরিত্রের জীবনের গল্প নিয়ে লেখা সেই বইটি সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছিল। ‘ফ্লেশ’ তাঁর ষষ্ঠ উপন্যাস।
বিবিসি রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সা-লাই বলেন, “যদিও আমার বাবা হাঙ্গেরীয় ছিলেন, আমি কখনো পুরোপুরি হাঙ্গেরিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনি। আমি সব সময় নিজেকে একটু বাইরের মানুষ মনে করেছি। এমনকি দীর্ঘ সময় যুক্তরাজ্য ও লন্ডনের বাইরে থাকার পরেও, লন্ডনের প্রতিও আমার সেই ‘বাইরের মানুষ’ হওয়ার অনুভূতি থেকেই গেছে।”
বুকার পুরস্কারের ইতিহাস শুরু ১৯৬৯ সালে, যা এখন বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সম্মান। এই পুরস্কার বহু লেখকের সাহিত্যজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। সালমান রুশদি, ইয়ান ম্যাকইওয়ান, অরুন্ধতি রায়, মার্গারেট অ্যাটউড ও সামান্থা হার্ভে—এই পুরস্কারের মাধ্যমে খ্যাতি পেয়েছেন। ২০২৪ সালে হার্ভে তাঁর ‘অরবিটাল’ উপন্যাসের জন্য এই সম্মান অর্জন করেন।
এ ছাড়া, চলতি বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের পৃথক ক্যাটাগরিতে ভারতীয় লেখক বানু মুস্তাক তাঁর ‘হার্ট ল্যাম্প’ উপন্যাসের জন্য পুরস্কৃত হন, যেখানে দক্ষিণ ভারতের মুসলিম নারীদের জীবনের ১২টি গল্প স্থান পেয়েছে।



