সূর্যগ্রহণ—একটি এমন মহাজাগতিক দৃশ্য, যা মুহূর্তের জন্য আকাশকে অন্ধকারে ঢেকে দেয় এবং পৃথিবীর পরিবেশে এনে দেয় অবিশ্বাস্য এক নীরবতা। এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে প্রতি বছর হাজারো মানুষ বিশ্বজুড়ে যাত্রা করেন, যাদের বলা হয় ‘ইক্লিপস চেজার’। সঠিক সময় ও জায়গায় উপস্থিত হওয়ার জন্য তাদের প্রস্তুতি চলে দীর্ঘদিন ধরে—স্থান নির্ধারণ, আবাসনের বুকিং, এমনকি বিশেষ পর্যবেক্ষণ সরঞ্জাম সংগ্রহও থাকে এই পরিকল্পনার অংশ।
২০২৪ সালের ৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের এক স্থানে প্রায় ৯৯% টোটালিটি পর্যবেক্ষণ করা এক দর্শনার্থী জানান, সূর্যগ্রহণের মুহূর্তে আকাশ ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে, পাখিরা নীরব হয়ে যায়, এবং বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এক ঠান্ডা আবহ। কয়েক মিনিটের জন্য যেন সময় থমকে যায়। আবার যখন সূর্য ফিরে আসে, সেই দৃশ্য মানুষের মনে আজীবনের মতো এক ছাপ ফেলে যায়।
এ ধরনের অনুভূতি নতুন নয়। প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত, মানুষ সূর্যগ্রহণে মুগ্ধ থেকেছে। ১৯৭০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সূর্যগ্রহণকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো যাত্রা শুরু হয় সংগঠিত “ইক্লিপস ট্যুরিজম”–এর। এরপর ১৯৭২ সালে প্রথম সূর্যগ্রহণভিত্তিক ক্রুজ আয়োজনের মধ্য দিয়ে এটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পায়। বর্তমানে এটি একটি বহুমিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক শিল্পে পরিণত হয়েছে।
২০২৪ সালের উত্তর আমেরিকান সূর্যগ্রহণের সময় নাসার হিসাব অনুযায়ী ৩ লাখেরও বেশি দর্শক উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ স্থানে। অনেক ট্যুর প্যাকেজ আয়োজনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বিক্রি শেষ হয়ে যায়।
অ্যাস্ট্রোনমি বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারির সময় মানুষ যখন ঘরে বন্দী ছিল, তখন রাতের আকাশই হয়ে উঠেছিল তাদের একমাত্র মুক্তির জানালা। সেই আগ্রহই এখন বাস্তব অভিজ্ঞতায় রূপ নিচ্ছে সূর্যগ্রহণ ভ্রমণে।
২০২৬ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। তাই যারা এ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চান, তাদের জন্য প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করা জরুরি।
২০২৬ সালের ১২ আগস্ট অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী পূর্ণ সূর্যগ্রহণ। এবার সূর্যের আলো ঢেকে যাবে আর্কটিক মহাসাগর, পূর্ব গ্রিনল্যান্ড, পশ্চিম আইসল্যান্ড এবং উত্তর স্পেনের আকাশে।
স্পেন:
এই গ্রহণে স্পেনের মায়োর্কা, মেনোরকা এবং ইবিজা দ্বীপে এক থেকে দুই মিনিট পর্যন্ত টোটালিটি দেখা যাবে। বালিয়ারিক সাগরের তীরে অবস্থিত পাহাড়ি অঞ্চল ও ঐতিহাসিক শহরগুলোকে বিশেষভাবে উপযুক্ত স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যটন প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই বিশেষ ‘ইক্লিপস ট্যুর’ চালু করেছে, যেখানে পর্যটকরা টেলিস্কোপের মাধ্যমে গ্রহণ দেখার পাশাপাশি জ্যোতির্বিদদের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পাবেন।
আইসল্যান্ড:
আইসল্যান্ডের ব্রেইদাফজরদুর উপসাগরে দুই মিনিট ১৮ সেকেন্ড পর্যন্ত সম্পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। সেখানে বরফাচ্ছন্ন পর্বত, আগ্নেয়গিরি ও কালো বালির সৈকতের পটভূমিতে গ্রহণ দেখার অভিজ্ঞতা হবে একেবারেই অন্যরকম। পর্যটন সংস্থাগুলো বরফঢাকা শৃঙ্গে ট্রেকিং ও গ্রহণ পর্যবেক্ষণের সমন্বিত আয়োজন করেছে।
গ্রিনল্যান্ড:
গ্রিনল্যান্ডের পূর্ব উপকূলের নির্জন অঞ্চলগুলোও থাকবে টোটালিটির মধ্যে, সময়কাল প্রায় দুই মিনিট ১৭ সেকেন্ড। এ অঞ্চলে পর্যটকরা ক্রুজের মাধ্যমে এই দৃশ্য দেখতে পারবেন, যেখানে জাহাজ বরফের রাজ্যে ভেসে সূর্যগ্রহণের মূল মুহূর্তে পৌঁছাবে।
মিশর ও মরক্কো:
২০২৭ সালের সূর্যগ্রহণে মিশরের নাইল নদী এবং মরক্কোর তানজিয়ের শহর থাকবে টোটালিটির রেখায়। মরক্কোতে প্রায় পাঁচ মিনিট পর্যন্ত সূর্যগ্রহণ দৃশ্যমান থাকবে। সেইসাথে মরুভূমির সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক শহরগুলো ভ্রমণের বিশেষ সুযোগও যুক্ত হবে এই ট্যুরে।
দক্ষিণ স্পেন ও উত্তর আফ্রিকা:
২০২৭ সালের গ্রহণে স্পেনের মালাগা ও কাদিজ শহর প্রায় তিন মিনিট পর্যন্ত অন্ধকারে ঢেকে যাবে। স্পেন, পর্তুগাল ও আফ্রিকার উপকূলজুড়ে বিভিন্ন ক্রুজ ও গাইডেড ট্রাভেল প্রোগ্রামও ইতোমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, পূর্ণ সূর্যগ্রহণ জীবনে একবার দেখাই যথেষ্ট, কারণ একই স্থানে একই ঘটনা পুনরায় দেখা প্রায় অসম্ভব। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও প্রতি বছর ৪ থেকে ৭টি আংশিক, পূর্ণ বা আংটাকৃতি গ্রহণ ঘটে, কিন্তু সেই মুহূর্তের অভিজ্ঞতা একেবারেই অনন্য।
একজন অভিজ্ঞ জ্যোতির্বিজ্ঞানীর ভাষায়, “যদি কখনও পূর্ণ সূর্যগ্রহণ না দেখে থাকেন, একবার হলেও দেখুন। এটি এমন এক অভিজ্ঞতা যা আপনি সারাজীবন ভুলবেন না।”



