Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeবিশেষ প্রতিবেদনCOP30 সম্মেলন: বিশ্বনেতাদের অনুপস্থিতিতে জলবায়ু আলোচনার ভবিষ্যৎ কোথায়?

COP30 সম্মেলন: বিশ্বনেতাদের অনুপস্থিতিতে জলবায়ু আলোচনার ভবিষ্যৎ কোথায়?

এক সময়ের ব্যস্ত জলবায়ু সম্মেলনের দলগত ছবি আজ যেন অতীত স্মৃতি। প্যারিসে অনুষ্ঠিত COP21 সম্মেলনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে সারি সারি বিশ্বনেতা, গাঢ় স্যুটে সজ্জিত পুরুষ ও নারী, পেছনে বিশাল ব্যানারে লেখা ছিল “COP21 Paris”। সেই ছবিতে এক সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, পাশেই ভবিষ্যতের রাজা তৃতীয় চার্লস, আর একটু দূরে ছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট—সবাই এক ফ্রেমে, এক লক্ষ্য নিয়ে।

কিন্তু ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত এই বছরের COP30 সম্মেলনের দৃশ্য একেবারেই ভিন্ন। বিশ্বের প্রায় ১৬০টি দেশের শীর্ষ নেতা, যার মধ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীও রয়েছেন, কেউই উপস্থিত হননি। বিশেষভাবে অনুপস্থিত ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও।

আসলে, বর্তমান মার্কিন প্রশাসন পুরোপুরি এই প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়িয়েছে এবং কোনো উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়নি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—যখন অধিকাংশ প্রভাবশালী নেতা অনুপস্থিত, তখন এই দুই সপ্তাহব্যাপী বৈশ্বিক সম্মেলনের প্রয়োজন কতটা?

জাতিসংঘের সাবেক জলবায়ু প্রধান, যার নেতৃত্বে ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি সম্পন্ন হয়েছিল, তিনি আগেই বলেছিলেন—বর্তমান COP প্রক্রিয়া এখন “অকার্যকর” হয়ে পড়েছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন আর জলবায়ু কূটনীতি নয়, বরং নবায়নযোগ্য শক্তি শিল্পে কে বেশি অর্থনৈতিক সুবিধা দখল করবে—এই নিয়েই প্রতিযোগিতা।

COP-এর ২৯টি বৈঠকের পরও যখন কার্বন নিঃসরণ কমছে না, বরং বাড়ছে, তখন প্রশ্ন থেকেই যায়—আরও COP আয়োজনের বাস্তব ফলাফল কী?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। তাঁর বক্তব্যে জলবায়ু পরিবর্তনকে তিনি “বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতারণা” বলে আখ্যা দেন। একইসাথে তেল, গ্যাস ও কয়লা শিল্পে বিধিনিষেধ তুলে দেন, ফসিল ফুয়েল কোম্পানিগুলোর জন্য বিলিয়ন ডলারের ট্যাক্স ছাড় দেন এবং নতুন খনিজ আহরণের জন্য সরকারি ভূমি উন্মুক্ত করেন।

মার্কিন প্রশাসন অন্যান্য দেশগুলোকে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে সরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস কিনতে আহ্বান জানিয়েছে। এর ফলে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো বিশাল পরিমাণে মার্কিন জ্বালানি আমদানি করছে।

এদিকে, ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্যোগে বাতাস ও সৌর শক্তিতে কর ছাড় ও ভর্তুকি কমানো হয়েছে। একাধিক প্রকল্প স্থগিত, গবেষণা তহবিল হ্রাস এবং পারমিট বাতিল করা হয়েছে। তাদের যুক্তি, দীর্ঘমেয়াদে ভর্তুকির ওপর নির্ভর না করে শিল্পগুলোকে এখন স্বনির্ভর হতে হবে।

অন্যদিকে, জলবায়ু উপদেষ্টারা এই নীতিকে “পরিচ্ছন্ন শক্তি ধ্বংসের রোডম্যাপ” বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মতে, এটি ২১শ নয়, ১৯শ শতাব্দীতে ফেরার প্রচেষ্টা।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের বিরোধিতায় বৈশ্বিক নৌপরিবহন খাতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিও ভেস্তে গেছে। এতে অনেকেই আশঙ্কা করছেন—যদি যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে দাঁড়ায়, তবে অন্যান্য দেশও একই পথ অনুসরণ করতে পারে।

এদিকে, চীন গত এক দশকে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি খাতে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশটির মোট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৪০% এসেছে ক্লিন টেকনোলজি থেকে। চীনের সৌর প্যানেল, ব্যাটারি, ইলেকট্রিক যান ও উইন্ড টারবাইন শিল্প এখন বৈশ্বিক বাজারের শীর্ষে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের এই অগ্রগতি এখন “অপরাজেয়”। ইউরোপ এখন দ্বিধায়—চীনকে বাজারে সুযোগ দিলে নিজস্ব শিল্প ধ্বংসের ঝুঁকি, আর সীমাবদ্ধ করলে জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা।

বৈশ্বিক এই বিভাজনের মাঝে COP30 অনুষ্ঠিত হচ্ছে ব্রাজিলে। জাতিসংঘের মহাসচিব আগেই জানিয়েছেন—প্যারিস চুক্তির ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমা এখন কার্যত অতিক্রমের পথে।

কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, বছরে একবারের এই বিশাল আয়োজনের পরিবর্তে প্রতি পাঁচ বছরে একটি বড় সম্মেলন যথেষ্ট। এতে বাস্তবায়নের জন্য শিল্পখাতকে সময় দেওয়া যাবে।

তবু COP এখনো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দেশগুলোর জবাবদিহি নিশ্চিত করে এবং জলবায়ু অর্থায়নে সমন্বয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে। এ বছরের সম্মেলনের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে আমাজন ও কঙ্গো বনের মতো রেইনফরেস্ট সংরক্ষণের জন্য একটি বৈশ্বিক তহবিল গঠন।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই এখন আর বহু দেশের সমন্বিত প্রতিশ্রুতির ওপর নয়, বরং অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ওপর নির্ভর করছে।

অবশেষে প্রশ্ন রয়ে যায়—COP কি তার উদ্দেশ্য হারিয়েছে, নাকি নতুন রূপে আরও প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে?

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments