ইউরোপের আকাশে তৈরি হয়েছে নতুন এক উদ্বেগ—রাশিয়া ও চীনের স্যাটেলাইট কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাজ্য ও জার্মানি সম্প্রতি জানিয়েছে, তাদের কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইটগুলো বারবার রুশ ও চীনা স্যাটেলাইটের নজরদারিতে পড়ছে। এসব স্যাটেলাইট শুধু নজরদারি নয়, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা সৃষ্টি বা ‘জ্যামিং’-এর ঘটনাও ঘটাচ্ছে বলে জানা গেছে।
জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সম্প্রতি এক মহাকাশ শিল্প সম্মেলনে বলেন, “রাশিয়ার কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে মহাকাশে, আমাদের সবার জন্য মৌলিক হুমকি হয়ে উঠেছে—যা আর উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।”
স্যাটেলাইট যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি হলে শুধু সামরিক নয়, বরং বেসামরিক ক্ষেত্রেও বড় প্রভাব পড়তে পারে। যেমন স্যাটেলাইট ইমেজিং, টেলিকম সার্ভিস বা ইন্টারনেট কানেকশন বিঘ্নিত হতে পারে। আর নেভিগেশন সিস্টেম ব্যাহত হলে তা বেসামরিক বিমান চলাচল বা সামরিক অভিযানে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকেই এসব ঘটনা আরও বাড়ছে। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাশিয়া এখন চীনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে—বেইজিং রাশিয়ার পক্ষে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে স্যাটেলাইট নজরদারি পরিচালনা করছে।
জার্মান প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি দুইটি রুশ রিকনাইসেন্স স্যাটেলাইটকে দেখা গেছে ইন্টেলস্যাটের দুটি স্যাটেলাইটের কাছাকাছি অবস্থান করতে। ইন্টেলস্যাট একটি বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট সার্ভিস কোম্পানি, যার সেবা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বহু সরকারি সংস্থা ব্যবহার করে থাকে।
তিনি আরও জানান, “রাশিয়া ও চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মহাকাশে যুদ্ধক্ষমতা বাড়িয়েছে। তারা এখন স্যাটেলাইটকে জ্যাম করতে, অন্ধ করতে বা ধ্বংস করতেও সক্ষম।” এ প্রেক্ষিতে জার্মানি তাদের মহাকাশ প্রকল্পে বহু বিলিয়ন ইউরোর বিনিয়োগ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে।
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের স্পেস কমান্ড প্রধানও জানিয়েছেন, রুশ স্যাটেলাইটগুলো প্রায় প্রতিসপ্তাহেই ব্রিটিশ স্যাটেলাইটের ওপর নজরদারি ও ‘জ্যামিং’ কার্যক্রম চালাচ্ছে। তিনি বলেন, “ওরা এমন পেলোড বহন করছে, যা আমাদের স্যাটেলাইটকে দেখতে ও তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম।”
রাশিয়া বহু বছর ধরে ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সক্ষমতা বাড়ানোর কাজ করছে—বিশেষত ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। এর বাইরে ন্যাটোর মহাসচিবও সতর্ক করেছেন যে রাশিয়া মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্র স্থাপনের মাধ্যমে স্যাটেলাইট ধ্বংসের পরিকল্পনা করছে।
যদিও রুশ প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, তাদের এমন কোনো পরিকল্পনা নেই, তবুও রাশিয়া ২০২৪ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধের প্রস্তাবে ভেটো দেয়। চীন সেখানে ভোটদানে বিরত থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি স্যাটেলাইটের উপস্থিতি শনাক্ত করা তুলনামূলক সহজ হলেও তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন। সাধারণত একটি স্যাটেলাইট অন্য স্যাটেলাইটের কাছাকাছি দীর্ঘ সময় অবস্থান করলে তা নজরদারির ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হয়।
রাশিয়ার এমন স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে কিছুতে অস্ত্র-সদৃশ প্রজেক্টাইলও পরীক্ষা করা হয়েছে বলে জানা যায়, যা অন্যান্য দেশের সম্পদের জন্য সরাসরি হুমকি হতে পারে।
রাশিয়ার এই কর্মকাণ্ড নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স এক দশকেরও বেশি আগে সতর্ক করেছিল যে রুশ স্যাটেলাইটগুলো তাদের সম্পদের ওপর নজরদারি করছে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছিল, রুশ সামরিক স্যাটেলাইট দুটি ইন্টেলস্যাটের কাছাকাছি অবস্থান নিয়েছিল। পরে ২০১৭ সালে ফ্রান্স-ইতালির একটি গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের কাছেও রুশ স্যাটেলাইট দেখা যায়।
চীনকেও এই ক্ষেত্রে সমান হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের মহাকাশ প্রযুক্তি আরও উন্নত এবং তাদের স্যাটেলাইটগুলো অত্যন্ত দ্রুত ও নিখুঁতভাবে অন্য স্যাটেলাইটের কাছে পৌঁছাতে পারে। চীনের কিছু স্যাটেলাইটে এমনকি রোবোটিক বাহু রয়েছে, যা অন্য স্যাটেলাইটকে সরিয়ে দিতে সক্ষম।
চীনের আর্থিক সক্ষমতাও বেশি, ফলে তারা মহাকাশে তাদের প্রভাব ক্রমশ বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং তাদের প্রযুক্তি তুলনামূলক পিছিয়ে আছে।
জার্মানি জানিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে তারা প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় করবে মহাকাশ নিরাপত্তায়। যুক্তরাজ্যও তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াচ্ছে এবং নতুন সেন্সর পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে, যা মহাকাশে লেজার হুমকি শনাক্ত করতে পারবে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। ইউরোপের দেশগুলোকে এখনই আরও বড় বিনিয়োগ করতে হবে, নাহলে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পেছনে পড়ে যাবে।
ন্যাটো ইতিমধ্যে মহাকাশকে একটি “অপারেশনাল ডোমেইন” হিসেবে ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ, কোনো সদস্য দেশের স্যাটেলাইটে আক্রমণ হলে তা সব সদস্যের ওপর আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার স্যাটেলাইট প্রযুক্তি এখনো ততটা কার্যকর নয়। ইউক্রেন যুদ্ধে দেখা গেছে, রুশ সেনারা অনেক সময় বাণিজ্যিক জিপিএস ব্যবহার করছে—যা তাদের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
সবমিলিয়ে, মহাকাশ এখন শুধু বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্র নয়, বরং বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও আধিপত্যের এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র।



