Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeঅন্যান্যঅলিভ গাছের ছায়ায় নিঃশব্দ সংগ্রাম: পশ্চিম তীরের জমিতে বাড়ছে সহিংসতা ও অসহায়তা

অলিভ গাছের ছায়ায় নিঃশব্দ সংগ্রাম: পশ্চিম তীরের জমিতে বাড়ছে সহিংসতা ও অসহায়তা

পশ্চিম তীরের হামরা অঞ্চলে নিজের পুরনো জমির দিকে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধা কৃষাণী। একসময় যেসব জলপাই গাছে ফল ঝুলত, আজ সেগুলো শুকিয়ে গেছে, শাখাগুলো ভাঙা ও পোড়া। দশকের পর দশক ধরে যত্নে লালিত সেই গাছগুলো এখন তার চোখের সামনে মৃতপ্রায়।

৭২ বছর বয়সী এই নারী বলেন, “আমি দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছি। আমার এত বছরের পরিশ্রমের ফল আজ ধুলোয় মিশে গেল।” তিনি জানান, পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই জমি তাদের পরিবারের সম্পদ। কিন্তু গত দুই বছর ধরে সহিংসতার কারণে তিনি নিজের জমিতে পা রাখতে পারছেন না।

তার জমিটি পশ্চিম তীরের জর্দান ভ্যালিতে অবৈধ বসতির বিপরীতে অবস্থিত। পরিবারটির অভিযোগ, সেখানে থাকা বসতি স্থাপনকারীরা বারবার তাদের হুমকি দিয়েছে, আক্রমণ করেছে, এমনকি জমি দখলের চেষ্টাও করেছে। ভয় পেয়ে তারা জমি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন।

এই সুযোগে বসতি স্থাপনকারীরা গরু ছেড়ে দিয়েছে জলপাই গাছের বাগানে, গাছগুলো খেয়ে নষ্ট করেছে পশুরা। তার ছেলে জানান, ফিরে এসে দেখেন বাড়ি তছনছ, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল চুরি, পানির ট্যাংক ও সেচ পাইপ সব ভাঙা। সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল—একটি জলপাইও অবশিষ্ট নেই।

তিনি বলেন, “আমাদের ভয় দেখিয়ে তাড়ানো হলো, তারপর আমাদের ঘরবাড়ি, গাছ, জীবন—সবকিছু ধ্বংস করে দিল। এখনো বুঝে উঠতে পারছি না কিভাবে সব হারালাম।”


ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও দায়মুক্তি

জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের হাতে অন্তত ৭৫৭টি সহিংস ঘটনার শিকার হয়েছেন ফিলিস্তিনিরা—যা গত বছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি। শুধুমাত্র চলতি জলপাই মৌসুমেই কৃষকদের ওপর হামলা হয়েছে অন্তত ২৫৯ বার এবং নষ্ট হয়েছে ৪,০০০-এরও বেশি গাছ ও চারা।

এই হামলার ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে—রক্তাক্ত কৃষক, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাগান ও আগুনে পোড়া জমি। জাতিসংঘ জানিয়েছে, দখলদার রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের উচিত এসব সহিংসতা বন্ধ করা এবং দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা।

তবে মাঠের বাস্তবতা অন্যরকম। অসংখ্য ভিডিওতে দেখা গেছে, মুখোশধারী বসতি স্থাপনকারীরা লাঠি, লোহার রড ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কৃষকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। অনেক সময় সেনার উপস্থিতিতেই এসব হামলা হয়। কিছু ঘটনায় সেনারাও জলপাই চুরি করেছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, ঘটনাগুলো সেনাবাহিনীর নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং বিষয়টি তদন্তাধীন।

ফিলিস্তিনিরা বলছেন, তাদের কোনো বিচার পাওয়ার পথ নেই, কারণ সেনারা প্রায়ই হামলাকারীদের পক্ষ নেয়। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিরা যেখানে সামরিক আইনের আওতায়, সেখানে বসতি স্থাপনকারীরা ভোগ করছে বেসামরিক আইনের সুবিধা—এটাই দ্বৈত আইনি বাস্তবতা।


অলিভ গাছ: জীবন ও অস্তিত্বের প্রতীক

জলপাই গাছ শুধু একটি ফসল নয়, এটি ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বের প্রতীক। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা এই গাছের মাধ্যমে জীবিকা ও ইতিহাসের যোগসূত্র টিকিয়ে রেখেছে। বর্তমানে প্রায় এক লক্ষ পরিবার তাদের আয় নির্ভর করে জলপাই ফসলের ওপর।

জাতিসংঘের কর্মকর্তারা একে গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাদের ভাষায়, “এই গাছ কেবল জীবিকা নয়, এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অস্তিত্বের প্রতীক।”

এই সহিংসতার কারণে অনেক পরিবার বছরের পর বছর জমিতে ফিরতে পারছে না। ফলে তাদের আয় হ্রাস পেয়েছে, জমি অনুর্বর হচ্ছে, আর গ্রামীণ জীবনে নেমে এসেছে হতাশা।

এক কৃষক জানান, গত দুই বছরে তিনি প্রায় ২৫ হাজার ডলারের সমমূল্যের ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি।


অবৈধ দখল ও বাধা-বিপত্তি

জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, পশ্চিম তীরজুড়ে এখন ৮৪৯টি সামরিক চেকপয়েন্ট ও লোহার গেট স্থাপন করা হয়েছে, যা ফিলিস্তিনিদের চলাচল কঠোরভাবে সীমিত করছে। অনেক অবৈধ বসতিও এখন বৈধ ঘোষিত হচ্ছে এবং দ্রুত বিস্তার ঘটছে।

এই পরিস্থিতিতে অনেকেই জমি ছাড়তে বাধ্য হলেও, কেউ কেউ এখনো প্রতিরোধে অটল।


অদম্য মায়ের শপথ

বৃদ্ধা কৃষাণী প্রতিদিন তার শুকিয়ে যাওয়া জলপাই বাগানে যান, শুকনো ডালপালার ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন নীরবে। ক্লান্ত কণ্ঠে বলেন, “আমরা তো শুধু গাছগুলোর যত্ন নিতে চাই। কেন তারা আমাদের এমন নির্যাতন করে?”

অবশেষে একটি গাছের নিচে বসে তিনি বলেন, “দশ বছরের পরিশ্রম, আমার জীবনের বিনিয়োগ সব এখানেই। তবুও আমি যাব না। এই জমিই আমার শেষ আশ্রয়।”

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments