Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeপ্রযুক্তি জগৎলাইকা: পৃথিবীর প্রথম মহাকাশ যাত্রী কুকুরের ইতিহাস

লাইকা: পৃথিবীর প্রথম মহাকাশ যাত্রী কুকুরের ইতিহাস

১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে একটি বিশেষ দিন হিসেবে স্মরণীয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের দ্বিতীয় মহাকাশযান ‘স্পুটনিক ২’ উৎক্ষেপণ করে। এই মহাকাশযানে ছিল লাইকা নামের একটি কুকুর, যিনি পৃথিবীর প্রথম প্রাণী হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণ করেছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মহাকাশে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পুটনিক ১ উৎক্ষেপণ করে বিশ্বের নজর কেড়ে নেয়। এর কিছুদিন পরেই স্পুটনিক ২ তৈরি করা হয়। এই মহাকাশযানটির মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের আগে প্রাণীকে মহাকাশের প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা সম্ভব কি না, তা পরীক্ষা করা। বিজ্ঞানীরা জানতেন, লাইকার মাধ্যমে পাওয়া অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে মানুষের মহাকাশযাত্রার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।

লাইকা ছিল মস্কোর রাস্তার একটি মিশ্র জাতের স্ত্রী কুকুর। তার শান্ত স্বভাব, ছোট আকৃতি এবং প্রশিক্ষণে স্থিতিস্থাপকতা থাকার কারণে তাকে নির্বাচন করা হয়। লাইকা একটি বিশেষ কক্ষচেম্বারে বসে থাকার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়। তার শরীরে সংযুক্ত করা হয়েছিল বিভিন্ন সেন্সর, যা তার হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ করত। তবে সেই সময়ে মহাকাশযানকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার প্রযুক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে ছিল না। ফলে, লাইকা মহাকাশে থাকা অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর কাজাখস্তানের একটি উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে স্পুটনিক ২ মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করা হয়। প্রথমে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছিলেন, লাইকা কয়েক দিন কক্ষপথে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু ২০০২ সালে রাশিয়ার বিজ্ঞানী প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করেন। জানা যায়, উৎক্ষেপণের সময় তীব্র শব্দ এবং কম্পনের কারণে লাইকা আতঙ্কিত হয়েছিলেন। মহাকাশযান পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছানোর পর তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় ত্রুটি দেখা দেয়। কেবিনের তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে চলে যায়। এই অতিরিক্ত তাপ ও মানসিক চাপের কারণে লাইকা উৎক্ষেপণের মাত্র পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে মারা যান।

লাইকার মহাকাশযাত্রা মানব ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও স্পুটনিক ২ উৎক্ষেপণ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিল, লাইকার মৃত্যু ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। বিশ্বজুড়ে মানুষদের মনে প্রশ্ন জন্মায়, প্রাণীদের নিরাপত্তা ও নৈতিক দায়িত্ব কতটা পালন করা হয়। লাইকার এই আত্মত্যাগ ভবিষ্যতের মানব মহাকাশযাত্রার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করে।

লাইকার নাম শুধু একটি কুকুরের ইতিহাস নয়, এটি মানব সভ্যতার জন্য মহাকাশ গবেষণার এক মাইলফলক। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি প্রায়শই নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের সঙ্গে জড়িত থাকে। এই ঘটনা সেই সময়ের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ ও প্রযুক্তিগত সাহসের প্রতীক হয়ে থেকে গেছে, যা আজও স্মরণীয়।

লাইকার মহাকাশযাত্রা প্রমাণ করে, মানব গবেষণার অগ্রগতি প্রায়শই প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা ও বিপদকে বিবেচনা করে করা উচিত। এই ঘটনা পৃথিবীর প্রথম প্রাণীর মহাকাশ ভ্রমণ হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে এবং গবেষক ও বিজ্ঞানীদের জন্য এক শিক্ষণীয় উদাহরণ হিসেবে রয়ে গেছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments