আজকের দ্রুতগতির জীবনে যখন মানসিক ক্লান্তি, স্ট্রেস ও “ডুমস্ক্রোলিং” আমাদের নিত্যসঙ্গী, তখন চিকিৎসার এক নতুন বিকল্প পাওয়া যাচ্ছে দেয়ালে ঝুলে থাকা শিল্পকর্মে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো গ্যালারিতে মূল শিল্পকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের শরীরের স্ট্রেস ও প্রদাহের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়, তুলনায় যারা একই শিল্পকর্মের প্রতিলিপি দেখেছেন তাদের তুলনায়।
গবেষণাটি পরিচালিত হয় লন্ডনের একটি আর্ট গ্যালারিতে, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের Self-Portrait with Bandaged Ear, মানে ও গগ্যাঁর বিখ্যাত শিল্পকর্মের সামনে কিছু সময় কাটান। ফলাফল বলছে—অরিজিনাল আর্টওয়ার্কের সামনে দাঁড়ানো মানে যেন একধরনের “চোখে দেখা ওষুধ” গ্রহণ করা, যা শরীর ও মন দুইয়ের উপরেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শিল্প মানুষের মন ভালো করে—এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু শিল্প শরীরের উপরও প্রভাব ফেলে—এ তথ্যটিই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কিংস কলেজ লন্ডনের এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের দুই দলে ভাগ করা হয়। একদলকে গ্যালারিতে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তারা ১৯ শতকের পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের—ভ্যান গঘ, তূলুজ লট্রেক, মানে ও গগ্যাঁর—মূল চিত্রগুলো দেখেন। অন্য দলটি একই চিত্রগুলোর কপি দেখেন ল্যাবে। সেন্সরের মাধ্যমে তাদের শরীরের প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করা হয়। ফলাফল স্পষ্ট—গ্যালারিতে গিয়ে মূল শিল্পকর্ম দেখা মানসিক চাপ হ্রাস করে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
এই তথ্যকে সমর্থন করছে আরও একাধিক গবেষণা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মনোবিজ্ঞানী সম্প্রতি ‘কেটল’স ইয়ার্ড’ গ্যালারিতে একটি সমীক্ষা চালান। তারা দেখেছেন, শিল্পের সৌন্দর্য উপভোগ করা মানুষের মনের “দৈনন্দিন বন্দিত্ব” থেকে মুক্তি দেয়। এর আগের বছর, সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম বিষয়ক বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক থেকেও উপকার বয়ে আনে—প্রতিজন মানুষের জন্য বছরে গড়ে এক হাজার পাউন্ড পর্যন্ত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং চিকিৎসা খরচ কমায়।
Nature সাময়িকীর পর্যালোচনায়ও বলা হয়েছে, শিল্প জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধে। এমনকি চিকিৎসাবিষয়ক ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা The Lancet তাদের ২০২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিল্পের উপর একটি ফটো প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখানো হয়েছে কিভাবে শিল্প মানুষের জীবনে প্রাণ যোগায়।
একজন শিল্প ইতিহাসবিদ তার নতুন বই How to Live an Artful Life-এ লিখেছেন, “যখন আপনি কোনো শিল্পকর্ম অনুভব করেন, তখন আপনি শুধু তা দেখেন না, বরং তা অনুভবও করেন। আমাদের উচিত কিছুটা সময় নিয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা।” এই সময়টাই আজকের দ্রুতগতির পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ঘাটতি। কিন্তু গবেষণা বলছে, এই সময় কাটানোই শিল্পের চিকিৎসাশক্তির মূল চাবিকাঠি।
গ্যালারি এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ কিছু সময়ের জন্য থেমে যায়, মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে, নিজের থেকে বাইরে এসে পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখে। শিল্পের সঙ্গে এমন গভীর সংযোগ মানসিক মুক্তি এনে দেয়। দার্শনিক আইরিস মারডক যেমন বলেছিলেন, “মহান শিল্প মুক্তি দেয়—এটি আমাদের নিজেদের বাইরের জগতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে শেখায়।”
যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) সৃজনশীলতাকে নিজের হাতে নিচ্ছে, তখন গ্যালারি আমাদের সামনে তুলে ধরে মানুষের মৌলিক সৃজনশক্তি। ভ্যান গঘের ব্রাশস্ট্রোকের গভীরতা অনুভব করলে আমরা তার অন্তর্নিহিত যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারি। মহান কবি অডেন যেমন বলেছেন, শিল্প আমাদের শেখায় মানুষের কষ্ট ও আমাদের উদাসীনতার মধ্যে পার্থক্য কীভাবে গড়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন উঠছে—যেমনভাবে ডাক্তাররা স্বাস্থ্যকর খাবার ও ব্যায়ামের পরামর্শ দেন, তেমনি কি একদিন “গ্যালারিতে ভ্রমণ”ও প্রেসক্রিপশনে আসবে? দর্শনার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়া ও তহবিল সংকটের সময়, এই গবেষণাগুলো আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে—শিল্পে বিনিয়োগ শুধু সংস্কৃতির নয়, বরং জনস্বাস্থ্যের জন্যও অপরিহার্য। সরকারের সাম্প্রতিক ২৭০ মিলিয়ন পাউন্ডের সাংস্কৃতিক অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল অবশ্যই ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে গবেষকরা বলছেন, আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন, যেন প্রতিটি মানুষ “সাংস্কৃতিক ব্যায়াম” বা cultural workout-এর সুবিধা পেতে পারে।
অর্থনীতি যেমন শক্তিশালী হয় শিল্পের মাধ্যমে, তেমনি স্বাস্থ্যও। বিজ্ঞানের তথ্য তাই বলছে—শিল্প এখন শরীর ও মনের ওষুধ।



