ইসরায়েলে সম্প্রতি এক বিতর্কিত ঘটনার সূত্রপাত ঘটেছে একটি ফাঁস হওয়া ভিডিওকে ঘিরে, যেখানে একটি সামরিক কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর নির্যাতন ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। এই ভিডিও প্রকাশের পর থেকে দেশটির শীর্ষ সামরিক আইন কর্মকর্তা গুরুতর তদন্তের মুখে পড়েছেন।
মাত্র এক সপ্তাহ আগেও তিনি ছিলেন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রধান আইন উপদেষ্টা, যার দায়িত্ব ছিল সামরিক বাহিনীর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা। কিন্তু বর্তমানে তিনি নিজেই গ্রেপ্তার হয়েছেন ভিডিও ফাঁস ও সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে।
ঘটনার সূত্রপাত ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। তখন সামরিক বাহিনীর আইনি শাখা তদন্ত শুরু করে একদল সৈনিকের বিরুদ্ধে, যারা গাজা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এক ফিলিস্তিনি বন্দিকে যৌন নির্যাতন করেছিল বলে অভিযোগ ওঠে। ভিডিওতে দেখা যায়, অন্য আরও কয়েকজন বন্দি মুখ নিচু করে শুয়ে আছে, আর সৈনিকরা তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। ঘটনাটি ঘটে দক্ষিণ ইসরায়েলের সিদে তেইমান সামরিক কারাগারে।
তদন্ত শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্যাপক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী সমর্থিত জোটের কিছু কট্টরপন্থী সদস্য সৈনিকদের পক্ষে বিক্ষোভ ও দাঙ্গায় অংশ নেন।
২০২৪ সালের আগস্টে দেশটির একটি টেলিভিশন চ্যানেল প্রথমবারের মতো ভিডিওটি সম্প্রচার করে। তবে এর আগেও, ওই কারাগারে বন্দিদের ওপর নির্যাতনের খবর সামনে এসেছিল। এক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে কর্মরত তিনজন হুইসেলব্লোয়ার কারাগারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ধরেছিলেন। পরে সরকার জানায়, তারা ধীরে ধীরে ওই কারাগারটি বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করবে।
তবে এসব পদক্ষেপও সামরিক আইনি কর্মকর্তার প্রতি ক্ষোভ কমাতে পারেনি।
তদন্তের পর তাকে তার দায়িত্ব থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এরপর তিনি নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন এবং স্বীকার করেন যে, তিনি ভিডিও প্রকাশের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং সেই সিদ্ধান্তের পূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছেন। পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, “আমার বিরুদ্ধে যে উসকানিমূলক প্রচারণা শুরু হয়েছে, তা এখন শীর্ষে পৌঁছেছে এবং এটি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ও মনোবলে গভীর ক্ষতি করছে।”
তিনি আরও লেখেন, “সবচেয়ে ভয়ংকর অপরাধীর বিরুদ্ধেও কিছু বিষয় করা যায় না। আমাদের আইনি ইউনিটের কর্মকর্তারা শুধুমাত্র আইনের পক্ষে দাঁড়ানোর কারণে ব্যক্তিগত হামলা, অপমান এবং হুমকির মুখে পড়েছেন।”
অন্যদিকে, সরকারের ডানপন্থী অংশ মনে করছে, তার পদত্যাগ যথেষ্ট নয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, অভিযুক্ত কর্মকর্তার পদমর্যাদা ও সামরিক উপাধি বাতিলের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যদিও ভিডিওর সত্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, তবুও পাঁচজন সৈনিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যারা অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনাকে ইসরায়েলের “সবচেয়ে বড় জনসংযোগ বিপর্যয়” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অন্য এক মন্ত্রী এই ঘটনাকে “আইনি মুখোশে আড়াল করা অপরাধমূলক আচরণ” বলে মন্তব্য করেছেন এবং পৃথক তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
ঘটনাটির মোড় ঘুরে যায় যখন কয়েক ঘণ্টার জন্য ওই আইন কর্মকর্তা নিখোঁজ হয়ে যান। সেনা ও পুলিশ একযোগে তল্লাশি চালিয়ে শেষ পর্যন্ত তেলআবিবের উত্তরে এক সৈকতে তাকে খুঁজে পায়। পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় প্রতারণা, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচারপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি ও সরকারি তথ্য ফাঁসের অভিযোগে।
এখনও পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়নি, তবে তদন্ত চলছে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এই মামলায় পাঁচজন সন্দেহভাজন রয়েছেন, যাদের মধ্যে সামরিক প্রসিকিউশন অফিসের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও আছেন।
অন্যদিকে, যে ফিলিস্তিনি বন্দিকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে, তাকে ইতোমধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় গাজায় ফেরত পাঠানো হয়েছে, যা মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ জটিল করে তুলেছে।
এই ঘটনা এখন ইসরায়েলের বিচার বিভাগকে ঘিরে রাজনৈতিক বিরোধের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ন্যায়বিচার মন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, তদন্ত প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটছে এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে।
এই পুরো কেলেঙ্কারি ইসরায়েলের বিচার ব্যবস্থা, সামরিক নৈতিকতা এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতার ওপর বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।



