Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeঅন্যান্যগাজা থেকে বেঁচে ফেরা সেই আলোকচিত্রী এখন মানবতার আলো খুঁজছেন

গাজা থেকে বেঁচে ফেরা সেই আলোকচিত্রী এখন মানবতার আলো খুঁজছেন

গাজার এক তরুণ আলোকচিত্রী যুদ্ধের বিভীষিকা নিজের চোখে দেখেছেন—ক্যামেরায় বন্দি করেছেন ধ্বংস, মৃত্যু আর মানবতার বিলাপ। নিজের পরিচিত শহরেই ১০৭ দিন তিনি কাজ করেছেন এক ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে প্রতিটি ছবি যেন ছিল কষ্টের বাস্তব দলিল।

যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর পক্ষে গাজায় প্রবেশ করা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন তিনিই ছিলেন সামনের সারিতে—যুদ্ধের প্রথম দিকের দিনগুলোতে তিনি নিজের ক্যামেরায় ধারণ করেন সেই কঠিন বাস্তবতা।

গত দুই বছরে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, গাজায় নিহত হয়েছেন ৬৮ হাজারেরও বেশি মানুষ। ৯০ শতাংশের বেশি আবাসিক ভবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ বাসিন্দা এখন বাস্তুচ্যুত।

নিজেকে বেঁচে থাকা সৌভাগ্যবান মনে করেন এই আলোকচিত্রী। তাঁর ভাষায়, “আমার জীবন এখন আরও মূল্যবান, কারণ আমি বেঁচে আছি, কিন্তু অসংখ্য গাজাবাসী মারা গেছে—তাদের নাম কেউ মনে রাখে না।”

২১ মাস আগে তিনি নিজের পরিবারসহ কাতারে পালিয়ে যান। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন এবং বিভিন্ন মানবিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন গাজার মানুষের সহায়তায়। তিনি এখন পর্যন্ত প্রায় ৬ কোটি ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছেন, যা দিয়ে অসংখ্য জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।

সম্প্রতি তিনি নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা গাজার মানুষের জন্য খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, কম্বল এবং আশ্রয়সামগ্রী সরবরাহ করছে। তিনি একে বলেন “অন্ধকারে একটি আলো।”

জর্জিয়ার এক অনুষ্ঠানে ফাউন্ডেশনের নাম নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, অন্য কোনো নাম মাথায় আসেনি। তবে এই কাজ তাঁকে জীবনের নতুন অর্থ দিয়েছে। “যখন কারও কাছে সাহায্য পৌঁছে দিই, তখন আমি এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করি,” বলেন তিনি।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ২৪০ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। সাংবাদিকদের সুরক্ষা কমিটির তথ্য অনুযায়ী, গাজা এখন সাংবাদিকদের জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধক্ষেত্র।

গাজা ছাড়ার আগে তিনি অজ্ঞাত সূত্র থেকে একাধিক মৃত্যুর হুমকি পেয়েছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায়, “মৃত্যুর এত কাছাকাছি গিয়েও আমি বেঁচে আছি—এটা এক জটিল অনুভূতি।”

তাঁর বহু বন্ধু আর সহকর্মী নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার আত্মা নিস্তেজ হয়ে গেছে, অনেক সময় মনে হয় আমি ভেতর থেকে মৃত।” তবুও তিনি চেষ্টা করছেন মানসিক যন্ত্রণাকে নিজের নিয়ন্ত্রণ নিতে না দিতে।

যুদ্ধ শুরুর আগে তিনি ছিলেন একজন শিল্পপ্রেমী আলোকচিত্রী—বাজারের কোলাহল, সমুদ্রতটে শিশুদের খেলা—এসব ছিল তাঁর ক্যামেরার বিষয়। কিন্তু যুদ্ধ তাঁকে অন্য পথে ঠেলে দিয়েছে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে তোলা তাঁর এক ছবিতে দেখা যায়, ধসে পড়া একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা এক নারী। সেই ছবি পরবর্তীতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায় বছরের অন্যতম সেরা ছবির তালিকায়। কিন্তু এই স্বীকৃতিতে তিনি আনন্দ পাননি, কারণ সেটি এসেছে নিজের জাতির অশেষ দুঃখের বিনিময়ে।

এক অনুষ্ঠানে এক তরুণী কণ্ঠ ভারী করে বলেন, “আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, আপনি জীবিত আছেন—এটাই আমাদের আশার প্রতীক।” উত্তরে তিনি শুধু বলেন, “আমি নায়ক নই, আমি সুপারম্যানও নই—আমাকেও লাইনে দাঁড়িয়ে টয়লেটে যেতে হয়।”

তিনি বলেন, যুদ্ধ তাঁকে খ্যাতি দিয়েছে, কিন্তু শান্তি কেড়ে নিয়েছে। বর্তমানে তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১.৫ কোটি অনুসারী থাকলেও তিনি আগের মতোই সাধারণ মানুষ।

তবে ঘৃণা আর সমালোচনা তাঁকে ভেতর থেকে ক্ষতবিক্ষত করছে। “বুলেটের আঘাত কেমন হবে তা জানা যায়, কিন্তু শব্দের আঘাত ভিতরটা পুড়িয়ে দেয়,” তিনি বলেন।

তিনি যুদ্ধবিরতি ও শান্তির আশায় আছেন, কিন্তু মনে করেন এই শান্তি আসলে অসম। তাঁর ভাষায়, “আমরা শুধু হত্যাযজ্ঞ বন্ধ চেয়েছিলাম, কিন্তু সবকিছু হারানোর পরেই সবাই শুনল।”

বর্তমানে তিনি মানবিক কাজের মধ্যেই নিজেকে ব্যস্ত রাখছেন। ভবিষ্যতে গাজায় ফিরে সমুদ্রের পাশে একটি ঘর বানাতে চান। তাঁর ইচ্ছা, একদিন হয়তো গাজার তরুণদের জন্য কাজ করবেন—তবে সবকিছুর চেয়ে বড় স্বপ্ন, ক্যামেরা হাতে নিয়ে একদিন শুধুই প্রকৃতি আর প্রাণীর ছবি তোলা, “মানুষ নয়—কারণ মানুষ কষ্ট আর যন্ত্রণা বয়ে আনে।”

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments