আবারও দারফুরে রক্ত ঝরছে। এক সময় বিশ্ব বলেছিল “আর কখনও না”, কিন্তু সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর এল ফাশারের ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে সেই প্রতিজ্ঞা আজ ভুলে গেছে বিশ্ব।
দীর্ঘ ১৮ মাস ধরে চলা অবরোধের পর, রবিবার শহরটি দখলে যায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া বাহিনীর (RSF) হাতে। এই সময়টিতে নাগরিক হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, জিম্মি নেওয়া এবং জাতিগতভাবে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার অসংখ্য অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভাষায়, শহরটি এখন “একটি অন্ধকার নরক”।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, শহরের একটি হাসপাতালেই প্রায় ৪৬০ জনকে RSF সদস্যরা হত্যা করেছে। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে রক্তের দাগে ভেজা প্রাঙ্গণ, আর ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় নিরস্ত্র পুরুষদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে বহু নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। জাতিসংঘ নিশ্চিত করেছে—এই সহিংসতা জাতিগতভাবে লক্ষ্যভিত্তিক ছিল।
RSF বাহিনী মূলত জন্ম নিয়েছে জানজাওয়িদ মিলিশিয়া থেকে—যারা দুই দশক আগে দারফুরে অ-আরব জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল। সেই সময় বিশ্ব সম্প্রদায় একসুরে বলেছিল, “এমন আর কখনও ঘটতে দেওয়া হবে না।” অথচ আবারও সেই ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
RSF দাবি করছে তারা দায়ীদের বিচারের আওতায় আনবে, কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রমাণ নেই। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা পরিকল্পনাও প্রায় অর্ধেকেরও কম তহবিল পেয়েছে, ফলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
জাতিসংঘের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, “এল ফাশারের ঘটনা কেবল সুদানের ব্যর্থতা নয়, এটি বিশ্বব্যবস্থার ব্যর্থতা। যারা চোখ বন্ধ করে ছিল, তাদের হাতও রক্তে রঞ্জিত।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু নীরব থাকা নয়—বাইরের শক্তিগুলোর ভূমিকা এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কয়েক বছর আগে অভিবাসন রোধে সুদানকে কোটি কোটি ইউরো দিয়েছিল, যার একটি বড় অংশ RSF বাহিনীর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ব্যয় হয়। ফলে বাহিনীটি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে যে, বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের সামরিক সরঞ্জাম সুদানের যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে গেছে। সবচেয়ে বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে সমালোচনার মুখে আছে একটি উপসাগরীয় দেশ, যাদের বিরুদ্ধে RSF-কে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তার অভিযোগ উঠেছে। যদিও তারা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা ও স্যাটেলাইট চিত্র বলছে ভিন্ন কথা।
এখন RSF বাহিনী, নেতা হামেদতি-র নেতৃত্বে, দারফুরের প্রধান শহরগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দক্ষিণ কোরদোফান অঞ্চলে আক্রমণ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। অপরদিকে সুদানের সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে লড়ছে। বাস্তবে দেশটি এখন কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত—কেউ জিতছে না, কেউ হারও মানছে না। ফলে যুদ্ধের আগুন জ্বলতেই থাকবে যতদিন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ না হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব সম্প্রতি এক শুনানিতে জানিয়েছেন, সুদান সংকটে বাইরের দেশগুলোর ভূমিকা নিয়ে তিনি কঠোর অবস্থান নেবেন। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে তেমন চাপ দেখা যায়নি।
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার সংস্থা ও সাধারণ মানুষ এখন এই গণহত্যার প্রতিবাদে সরব হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট উপসাগরীয় দেশটি নিজেদের “স্থিতিশীল ও আধুনিক” ভাবমূর্তি ধরে রাখতে সচেষ্ট থাকলেও, দারফুরের এই রক্তক্ষয় তাদের নৈতিক অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কারণ, যখন এল ফাশারে রক্ত প্রবাহিত হয়, তখন তার ছোঁয়া সীমান্ত পেরিয়ে অন্য হাতেও লেগে যায়।



