ভয়ংকর ঝড় ‘মেলিসা’–এর তীব্রতা ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলা এই ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রভাগে প্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহ করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডল বিষয়ক সংস্থার (NOAA) একদল বিশেষজ্ঞ, যাদের বলা হয় “হারিকেন হান্টারস”। এরা ঝড়ের ভেতর উড়ে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেন, যা পরে আবহাওয়া পূর্বাভাস ও দুর্যোগ প্রস্তুতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কিন্তু এবার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। সরকারী কার্যক্রম স্থবির হয়ে যাওয়ায় এই বিশেষজ্ঞ দলটি কোনো বেতন ছাড়াই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। জীবন ঝুঁকির মধ্যেও তারা ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে, কারণ তাদের কাজকে জননিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য ধরা হয়।
এই দলের ব্যবহৃত বিশেষ উড়োজাহাজগুলোতে রয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি—যার মধ্যে অন্যতম একটি টেল-মাউন্টেড ডপলার রাডার, যা ঝড়ের অভ্যন্তরের ত্রিমাত্রিক চিত্র তৈরি করতে সক্ষম। এই তথ্যগুলো সরাসরি কম্পিউটার মডেলে পাঠানো হয়, যা ঝড়ের গতিপথ ও শক্তি নির্ধারণে সহায়ক হয়।
‘মেলিসা’ যখন সপ্তাহজুড়ে ক্যারিবীয় অঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, তখন এই ঝড় গবেষক দলের সদস্যরা ক্রমাগত আর্থিক চাপে পড়ছেন। সংস্থার দীর্ঘদিনের ব্যবহৃত WP-3D বিমানের ক্রুরা ইতোমধ্যে দুই দফা বেতন পাননি। একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “এই পরিবেশে মানসিকভাবে শতভাগ মনোযোগী থাকা খুব কঠিন, বিশেষ করে যখন পরিবার চালানোর জন্য সঞ্চয়ে হাত দিতে হয়।”
ঝড়ের মধ্য দিয়ে উড়ানগুলো ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। প্রচণ্ড টারবুলেন্সের কারণে এক বিমানের নিরাপত্তা সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় সেটি বাধ্য হয়ে ঘাঁটিতে ফিরে আসে এবং পরিদর্শনের পর আবার একই দিনে উড়াল দেয়। উড়োজাহাজের ভেতর তোলা এক ভিডিওতে দেখা গেছে, ঝড়ের প্রচণ্ড দোলায় যন্ত্রপাতি ছিটকে পড়ছে, ক্রুরা নিরাপত্তা বেল্টে টান খাচ্ছেন—কেউ চিৎকার করছেন, কেউ হাসছেন ভয় সামলাতে।
যদিও সরকারি অচলাবস্থার কারণে তারা পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না, তবুও জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্রের সব অনুরোধ তারা পূরণ করে চলেছেন। ওই কেন্দ্র তাদের নির্দিষ্ট রুট ও সময়সূচি দেয় যেখানে বাস্তব তথ্য সংগ্রহ পূর্বাভাসকে সবচেয়ে বেশি উন্নত করতে পারে।
NOAA–এর প্রতিটি উড়োজাহাজে প্রায় ২০ জনের মতো ক্রু সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও তারা ধারাবাহিকভাবে ঝড় পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছেন।
‘মেলিসা’ যখন জ্যামাইকার উপকূলে আঘাত হানে, তখন দ্বীপটিতে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং কমপক্ষে ১৯ জন প্রাণ হারান। তবুও দলটি উড়ান চালিয়ে গেছে, আন্তর্জাতিক সহযোগী দেশগুলোর সহায়তায়। বৃহস্পতিবারের এক উড়ান ছিল বারমুডার বাসিন্দাদের সঠিক সতর্কতা পৌঁছে দিতে।
NOAA–এর এক মুখপাত্র জানান, সংস্থা তাদের এই সাহসী সদস্যদের কঠোর পরিশ্রম এবং আর্থিক চাপ উভয়েরই স্বীকৃতি দেয়। তিনি বলেন, “সরকারি অচলাবস্থার দ্রুত অবসান কামনা করছি, কারণ এই পরিস্থিতিতে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও বেতন পাচ্ছেন না, অথচ তাদের কাজই আমেরিকান নাগরিকদের জীবন রক্ষা করছে।”
একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর রিজার্ভ ইউনিটও এই ঝড়ে কয়েকটি মিশনে অংশ নেয়, যদিও তাদের বিমানে NOAA–এর মতো উন্নত গবেষণা সরঞ্জাম ছিল না। তারা মূলত ঝড়ের গতি ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ করেছে। তবে এক পর্যায়ে বিমানবাহিনীর একটি উড়োজাহাজকেও প্রবল টারবুলেন্সের কারণে ফিরে আসতে হয়।
‘মেলিসা’ যখন দক্ষিণ-পশ্চিম জ্যামাইকার দিকে এগোচ্ছিল, তখন এটি ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী আটলান্টিক হারিকেনের একটি ছিল, যার স্থায়ী বেগ ছিল ঘণ্টায় ১৮৫ মাইল।
NOAA–এর ঝড় গবেষণা বিভাগে যুক্ত এক বিশেষজ্ঞ জানান, “এই মিশনটি আমার সাত বছরের অভিজ্ঞতার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ছিল। তীব্র উর্ধ্ব-নিম্ন বায়ুপ্রবাহে বিমানের নিরাপত্তা বজায় রাখা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের অনেক সহকর্মী এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কাজ করেও কোনো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। তারা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।”



