কোয়ান্টাম প্রযুক্তির দুনিয়ায় এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে গুগলের গবেষক দল। তারা “কোয়ান্টাম ইকোস” নামের এক অভিনব কৌশল ব্যবহার করে এমন একটি অ্যালগরিদম তৈরি করেছে, যা প্রচলিত ক্ল্যাসিক্যাল সুপারকম্পিউটারকে ছাড়িয়ে গেছে কার্যক্ষমতায়। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং তত্ত্বে এটি এখন পর্যন্ত অন্যতম বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই নতুন অ্যালগরিদম এমনভাবে কাজ করে, যেখানে একটি কোয়ান্টাম প্রসেসর বিপুল সংখ্যক গণনা কয়েক মিনিটের মধ্যেই সম্পন্ন করতে পারে—যে কাজ একই মানের সুপারকম্পিউটার করতে গেলে কয়েক দশক সময় লাগবে। এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের সক্ষমতাকে আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে এবং ভবিষ্যতের কম্পিউটিং ব্যবস্থাকে এক নতুন দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
গুগল জানিয়েছে, ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোনো কোয়ান্টাম কম্পিউটারে এমন একটি যাচাইযোগ্য অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হলো, যা বাস্তবভাবে সুপারকম্পিউটারের সীমা অতিক্রম করেছে। এখানে “যাচাইযোগ্যতা” বলতে বোঝায়—এই ফলাফলকে একই ধরনের কোয়ান্টাম কম্পিউটার বা সমমানের প্রযুক্তিতে পুনরায় যাচাই করা সম্ভব। এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় যে ফলাফলটি কেবল তত্ত্বগত নয়, বরং বাস্তবিকও। এই পুনরাবৃত্তিযোগ্যতা কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে ভবিষ্যতের ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য আরও নির্ভরযোগ্য করে তুলেছে।
প্রচলিত কম্পিউটারে তথ্য প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত হয় “বিটস”, যা একসঙ্গে হয় ০ অথবা ১। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারে ব্যবহৃত হয় “কিউবিট”, যা একইসঙ্গে ০ এবং ১ উভয় অবস্থায় থাকতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার একই সময়ে একাধিক সম্ভাবনা যাচাই করতে পারে, যা তাদের গণনাক্ষমতাকে অসাধারণ মাত্রায় উন্নত করে। তবে এই কিউবিটগুলোকে দীর্ঘ সময় স্থিতিশীল রাখা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ অল্প তাপমাত্রা ও ক্ষুদ্র কম্পনও তাদের কোয়ান্টাম অবস্থা ভেঙে দিতে পারে।
গুগলের তৈরি “উইলো” নামের কোয়ান্টাম চিপের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্যই “কোয়ান্টাম ইকোস”-এর ওপর ভিত্তি করে এই অ্যালগরিদম তৈরি করা হয়েছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই উইলো চিপ কয়েক মিনিটেই এমন একটি জটিল হিসাব সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে, যা পৃথিবীর দ্রুততম ক্ল্যাসিক্যাল সুপারকম্পিউটার করতে প্রায় ৪৭ বছর সময় নিত।
বিজ্ঞানীদের মতে, এই সাফল্য কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের সম্ভাবনাকে আরও এগিয়ে নিলেও, প্রযুক্তিটি এখনো দৈনন্দিন ব্যবহারের উপযোগী নয়। কারণ, ত্রুটির হার কমানো, প্রায় পরম শূন্য তাপমাত্রায় স্থিতিশীল কোয়ান্টাম অবস্থা বজায় রাখা, এবং বাস্তব প্রয়োগে নির্ভরযোগ্যতা অর্জন—এই চ্যালেঞ্জগুলো এখনও বড় বাধা হয়ে আছে।
তবে এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যা ভবিষ্যতে জটিল গণনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ঔষধ তৈরির মডেলিং এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে। অনেকের মতে, এটি কোয়ান্টাম যুগের বাস্তব সূচনা।
গুগলের এই উদ্ভাবন প্রমাণ করেছে—প্রচলিত প্রযুক্তির সীমা অতিক্রম করা এখন আর কেবল তত্ত্ব নয়, বরং সময়ের ব্যাপার। আগামী দিনে এই প্রযুক্তি হয়তো এক নতুন বৈপ্লবিক বাস্তবতা তৈরি করবে, যা বদলে দেবে আমাদের গণনার ধরন এবং কম্পিউটারের ধারণা।



