ইতালিতে সাংবাদিকতার পরিবেশ ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। দেশটির রাজনৈতিক বিভাজন ও প্রভাবশালী মহলের চাপের কারণে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ইতালির ইতিহাসে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং মাফিয়া প্রভাব বরাবরই আলোচনায় ছিল। ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকের “lead years” নামে পরিচিত সময়টি ছিল চরম অস্থিরতার — যখন রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ এবং মাফিয়া হত্যাকাণ্ড প্রায় স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। দীর্ঘ ৪৫ বছর পরও সেই অতীত যেন দেশটির বর্তমানকে তাড়া করছে। সম্প্রতি এক সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৯৮০ সালে সিসিলির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পিয়ারসান্তি মাত্তারেল্লাকে হত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে।
এই ঐতিহাসিক পটভূমির মধ্যেই ইতালির এক শীর্ষ অনুসন্ধানী সাংবাদিকের গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটার ঘটনা আবারও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমের জনপ্রিয় একটি অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ওই সাংবাদিক, যিনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দুর্নীতি ও সংগঠিত অপরাধ নিয়ে কাজ করছেন। চলতি মাসের শুরুতে রোমের নিকটবর্তী তার বাসার সামনে রাখা কালো মার্সিডিজ গাড়িতে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি সংগঠিত অপরাধচক্রের পরিকল্পিত হামলা, যা সময়মতো নিষ্ক্রিয় হওয়ায় বড় বিপর্যয় এড়ানো গেছে।
ঘটনাটি মাল্টার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ড্যাফনি কারুয়ানা গালিজিয়ার হত্যার অষ্টম বার্ষিকীর দিন ঘটেছে, যা আরও সন্দেহজনক মনে করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি মাফিয়া চক্রের কাজ, কারণ ওই সাংবাদিকের অনুষ্ঠানের সাম্প্রতিক মৌসুমে ক্যালাব্রিয়ার কুখ্যাত ’এনদ্রাঙ্গেতা’ সংগঠনের ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের কথা রয়েছে। অতীতে এই সংগঠন থেকে তিনি বহুবার হুমকি পেয়েছেন এবং ২০২১ সাল থেকে তিনি বাড়তি পুলিশ সুরক্ষায় রয়েছেন।
তবে শুধুমাত্র অপরাধচক্রের হুমকি নয়, ইতালিতে সাংবাদিকদের জন্য আরেকটি বড় বাধা হয়ে উঠেছে আইনি হয়রানি। প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্বাধীন বর্তমান জোট সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছে সাংবাদিকদের ভয় দেখানো, হয়রানি এবং মামলা দিয়ে চুপ করানোর অভিযোগে। বিস্ফোরণের পর প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা জানালেও, তার সরকারের কর্মকাণ্ড সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থায় প্রচারিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এক ব্যক্তিকে নিয়ে প্রকাশিত হওয়ার পর ক্ষমতাসীন জোটের সদস্যরা নাকি সেই অনুষ্ঠান বন্ধ করার চাপ সৃষ্টি করেন। এর পর ওই সাংবাদিককে সংসদীয় কমিটির সামনে হাজির হয়ে তার প্রতিবেদনের পদ্ধতি ও অর্থায়ন নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। শুধু তিনিই নন, সরকারের শীর্ষ দলীয় নেতারা আরও কয়েকজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও এক কার্টুনিস্টের বিরুদ্ধেও মামলা করেছেন।
এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় কমিশন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইতালির সরকারি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে। কমিশন জানিয়েছে, রোম এখনো মানহানির কড়াকড়ি আইন সংস্কার করতে পারেনি, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নীতিমালার পরিপন্থী।
ঘটনার পর ওই সাংবাদিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “একটি বোমা যা প্রাণহানি ঘটায়নি, তা বেশি ভয়ংকর, নাকি সেই রাজনীতিকরা যারা প্রতিনিয়ত সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করছেন?”
তবে প্রধানমন্ত্রী এসব অভিযোগকে “মিথ্যা প্রচারণা” বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, “গণতন্ত্রে তথ্যের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা কোনোভাবেই আপসযোগ্য নয়।” কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাম্প্রতিক মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, ইতালির গণমাধ্যম স্বাধীনতার অবস্থান দ্রুত নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন সরকারের সময় সাংবাদিকদের জন্য পেশাগত ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধের জন্য একটি অশনিসঙ্কেত।



