খুলনা থেকে ঢাকায় বাসে আসতে সময় লেগেছে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা। কিন্তু রাজধানীতে প্রবেশের পর সেই যাত্রাই পরিণত হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টার কষ্টে। সকালে খুলনা থেকে রওনা হওয়া চালক সকাল ৯টার দিকে গাড়ি ছাড়েন এবং দুপুর সাড়ে বারোটায় পৌঁছে যান যাত্রাবাড়ীতে। কিন্তু গন্তব্য গুলিস্তান টোল প্লাজায় এসে তার গাড়ি আটকে যায় দীর্ঘ যানজটে। ক্লান্ত মুখে চালক বলেন, “ঢাকা পৌঁছাই আগে আগে, কিন্তু ফ্লাইওভারে আটকে থেকে সময়ের অর্ধেক চলে যায়।”
এ দৃশ্য শুধু একদিনের নয়। প্রায় প্রতিদিনই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন চালক ও যাত্রীরা। ৪ অক্টোবর সকাল ১১টার দিকে যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে গুলিস্তানের পথে থাকা একটি বাস প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। জানালা দিয়ে দেখা গেল সামনে সারি সারি ট্রাক, বাস, রিকশা, মোটরসাইকেল—সব থেমে আছে। সামনে গিয়ে দেখা যায়, একটি কার্গো ট্রাক উল্টে পড়ে আছে, ফলে পুরো লেন বন্ধ হয়ে গেছে। এক দিকের যান অন্য দিকে উঠে পড়ায় উভয় দিকেই স্থবিরতা নেমেছে।
রাত ১০টার দিকেও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়। মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ীগামী একটি বাস আটকে আছে সায়েদাবাদ এলাকায়। এক যাত্রী বিরক্তি নিয়ে বলেন, “রাস্তায় গাড়ির চেয়ে ব্যাটারি চালিত রিকশাই বেশি, ওরাই পুরো রাস্তা দখল করে রেখেছে।”
ফ্লাইওভারের চাপ বাড়ছে, সুফল ম্রিয়মাণ
দেশের প্রায় ৪০টি জেলার গাড়ি প্রতিদিন ঢাকায় প্রবেশ করে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ব্যবহার করে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে এই রাস্তায় গাড়ির চাপ আরও বেড়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত নকশা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং ট্রাফিক আইন না মানার কারণে এই ফ্লাইওভারের উপরে ও নিচে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে দ্রুত ঢাকায় পৌঁছানোর সুবিধা হারিয়ে যাচ্ছে যানজটের ফাঁদে।
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১.৫ কিলোমিটার। এটি শনির আখড়া থেকে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান হয়ে চানখাঁরপুল পর্যন্ত বিস্তৃত। দক্ষিণাঞ্চলের গাড়িগুলো সাধারণত দোলাইরপাড় দিয়ে ওঠে, চট্টগ্রাম বিভাগের গাড়িগুলো শনির আখড়া দিয়ে, সিলেট বিভাগের গাড়িগুলো ডেমরা দিয়ে এবং বিভিন্ন জেলার পরিবহন সায়েদাবাদ হয়ে ওঠানামা করে। ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দারাও এই রাস্তাটি ব্যবহার করেন নিয়মিত যাতায়াতের জন্য।
তিন স্থানে স্থায়ী যানজট
ফ্লাইওভারের তিনটি জায়গায় প্রায় নিয়মিত যানজট লেগেই থাকে—প্রথমত ওঠার সময়, দ্বিতীয়ত সায়েদাবাদ অংশে, এবং তৃতীয়ত নামার সময় গুলিস্তান ও চানখাঁরপুল এলাকায়। দেখা গেছে, অনেক পরিবহন ফ্লাইওভারে ওঠার আগে যাত্রী ওঠানামা করায় মূল রাস্তায় জট তৈরি হয়। আবার টোল প্লাজার সামনে ধীরগতির কারণে গতি কমে যায়। আর ফ্লাইওভার নামার সময় চার লেনের রাস্তা সংকুচিত হয়ে দুই বা এক লেনে নেমে আসে, ফলে দীর্ঘ লাইনে আটকে থাকে গাড়ি।
ফ্লাইওভারের নিচের দুরবস্থা
ফ্লাইওভারের নিচের সড়কটির অবস্থাও ভালো নয়। যাত্রাবাড়ী থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত রাস্তার জায়গায় জায়গায় গর্ত, বৃষ্টি হলেই পানি জমে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে ধুলার দাপট অসহনীয়।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালও যানজটের বড় কারণ। ১৯৮৪ সালে নির্মিত এই টার্মিনালের ধারণক্ষমতা ৭০০ থেকে ৮০০ বাসের হলেও বর্তমানে প্রায় ৩,০০০ বাস রাখা হয় এখানে। টার্মিনালের বাইরে অসংখ্য অবৈধ কাউন্টার ও পরিবহন দাঁড়িয়ে থাকে, যা মূল সড়ককে সংকুচিত করে। অনেক সময় দেখা যায়, এই টার্মিনালের ভেতরেও অবৈধ কার্যক্রম চলছে। পরিবহন মালিক সমিতির একজন নেতা বলেন, “অদৃশ্য দালাল সিন্ডিকেটের দখল না ভাঙলে এই টার্মিনালের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।”
সময় ও অর্থের অপচয়
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের এক জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার যাত্রীরা প্রতি দুই ঘণ্টায় ৪৬ মিনিট যানজটে আটকে থাকেন, যা বছরে প্রায় ২৭৬ ঘণ্টার সমান। বিশ্বব্যাংক ও বুয়েটের হিসাব বলছে, ২০০৭ সালে ঢাকার গাড়ির গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার, ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৪.৮ কিলোমিটারে। যানজটের কারণে দৈনিক প্রায় ৮২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, যার আর্থিক ক্ষতি প্রতিদিন প্রায় ১৩৯ কোটি টাকার সমান।
এক চাকরিজীবী বলেন, “ফ্লাইওভার করার উদ্দেশ্য ছিল সময় বাঁচানো, কিন্তু এখন সেখানে আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। নিচের রাস্তার বিকল্প আছে, কিন্তু ফ্লাইওভারে একবার আটকে গেলে আর নড়াচড়া করা যায় না।”
সমাধান কোথায়?
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, শুধুমাত্র ফ্লাইওভার দিয়ে যানজট কমানো সম্ভব নয়। ফ্লাইওভারের নিচের সড়কগুলো সংস্কার ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করা জরুরি। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, “নিচের রাস্তা ঠিক না করলে ফ্লাইওভারের চাপ কখনোই কমবে না। ট্রাফিক পুলিশের তদারকিও বাড়াতে হবে।”
ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা যাত্রাবাড়ীর আশপাশের অবৈধ কাউন্টারগুলো সরিয়ে সায়েদাবাদ টার্মিনালের ভেতরে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
যাত্রাবাড়ীর অবহেলা ও স্থানীয় ক্ষোভ
যাত্রাবাড়ী এলাকায় যানজট, ভাঙাচোরা রাস্তা ও আবর্জনার গন্ধ এখন নিত্যদিনের চিত্র। স্থানীয়দের অভিযোগ, ফ্লাইওভারের কারণে উপরের রাস্তা ঠিক রাখা হলেও নিচের দিকে কোনো নজর দেওয়া হয় না। এক বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “উন্নয়নের নাম শুধু উপরে, নিচে দেখলে বোঝা যায় যাত্রাবাড়ী এখনো অবহেলিত।”



