সৌরজগৎ গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি গ্রহই ছিল এক অস্থিতিশীল অবস্থায়। সূর্যের প্রচণ্ড আকর্ষণ বলের কারণে অনেক গ্রহই সূর্যের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া বা দূরে সরে যাওয়ার ঝুঁকিতে ছিল। সেই সময় সূর্যের কাছাকাছি থাকা পৃথিবীও একই বিপদের মুখে পড়ে। তবে সৌভাগ্যবশত, এক বিশাল গ্রহের প্রভাবেই পৃথিবী সূর্যের ভয়ংকর আকর্ষণ থেকে রক্ষা পায় — সেই গ্রহটি হলো বৃহস্পতি।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানিয়েছেন, সৌরজগতের গঠনকালীন সময়ে বৃহস্পতির বিশাল আকার ও মহাকর্ষীয় প্রভাব পৃথিবীকে সূর্যের দিকে টেনে নেওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স অ্যাডভান্সেস-এ, যেখানে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কীভাবে বৃহস্পতি সৌরজগতের স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
গবেষকদের মতে, সৌরজগৎ গঠনের প্রাথমিক অবস্থায় বৃহস্পতি গ্রহ তার বিশাল মহাকর্ষ বলের মাধ্যমে গ্যাস ও ধূলিকণার প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। বৃহস্পতি যখন ধীরে ধীরে আকারে বড় হতে থাকে, তখন এটি অভ্যন্তরীণ সৌরজগতের দিকে আসা পদার্থের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে সূর্যের কাছাকাছি থাকা ছোট গ্রহগুলো, বিশেষ করে পৃথিবী, নিরাপদ অবস্থানে থেকে বিকাশ লাভ করতে পারে।
বিজ্ঞানীরা আরও জানান, বৃহস্পতির এই মহাকর্ষীয় প্রভাব শুধু পৃথিবী নয়, বরং পুরো সৌরজগতের গঠন কাঠামোকেও পরিবর্তন করেছিল। বৃহস্পতি সৌরবলয়ের মধ্যে একটি ফাঁকা স্থান তৈরি করে, যা সৌরজগতকে দুটি ভাগে ভাগ করে দেয় — অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ অঞ্চল। এই বিভাজন দুটি অঞ্চলের উপাদানের মিশ্রণকে বাধা দেয়, যার ফলে উল্কাপিণ্ড ও অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষিত থাকে।
একজন গবেষক জানান, বৃহস্পতি না থাকলে পৃথিবী আজকের মতো একটি বাসযোগ্য গ্রহে পরিণত হতো না। কারণ, বৃহস্পতি শুধুমাত্র সূর্যের আকর্ষণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেনি, বরং উল্কাপিণ্ড ও ধূলিকণার চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে পৃথিবীর কক্ষপথকেও স্থিতিশীল রেখেছে।
গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো — বৃহস্পতি সৌরজগতের অভ্যন্তর ও বাইরের অঞ্চলের মধ্যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য তৈরি করেছে। এর ফলে সৌরজগতের গঠনকালীন বিশৃঙ্খলা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসে। এই প্রভাব আজও টিকে আছে বলে উল্লেখ করেছেন গবেষকরা।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা চিলির অ্যাটাকামা লার্জ মিলিমিটার-সাবমিলিমিটার অ্যারে টেলিস্কোপ (ALMA)-এর মাধ্যমে বৃহস্পতির প্রাথমিক গঠনকালীন প্রভাব আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তারা আশা করছেন, এই পর্যবেক্ষণ ভবিষ্যতে সৌরজগতের বিকাশ এবং পৃথিবীর অস্তিত্ব সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্ট ধারণা দেবে।
গবেষণার সারমর্মে বলা হয়েছে, বৃহস্পতি ছিল সৌরজগতের “প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ”। সূর্যের প্রচণ্ড আকর্ষণ শক্তির বিপরীতে এই বিশাল গ্রহের উপস্থিতিই পৃথিবীর নিরাপদ অবস্থান নিশ্চিত করেছে। সৌরজগতের ভারসাম্য রক্ষায় বৃহস্পতির ভূমিকা আজও তেমনি অটুট — যা পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহকে তাদের কক্ষপথে স্থিতিশীলভাবে ধরে রেখেছে।



