প্রযুক্তির অগ্রগতিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। দৃষ্টি হারানো মানুষদের আবারও আলো দেখার সুযোগ দিচ্ছে ইলেকট্রনিক ইমপ্লান্ট। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই উদ্ভাবন যেমন আশার আলো জ্বালাচ্ছে, তেমনি এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জটিল নৈতিক ও ঝুঁকির প্রশ্নও।
মানব চোখ শুধু দৃষ্টির মাধ্যম নয়, এটি আসলে মস্তিষ্কেরই এক সম্প্রসারণ। রেটিনা এবং অপটিক নার্ভ সরাসরি মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। সেই জায়গাতেই ইলেকট্রনিক ইমপ্লান্টের মাধ্যমে দৃষ্টি ফেরানোর এই নতুন প্রযুক্তি কাজ করছে। এই প্রযুক্তি কোনো সায়েন্স ফিকশন কল্পনার মতো “সুপার হিউম্যান” তৈরি করছে না, বরং যারা বার্ধক্যজনিত দৃষ্টিহীনতায় ভুগছেন তাদের জীবনযাত্রায় বাস্তব পরিবর্তন আনছে।
বর্তমানে প্রায় ছয় লক্ষাধিক মানুষ বয়সজনিত ম্যাকুলার ডিজেনারেশন বা কেন্দ্রীয় দৃষ্টিশক্তি হারানোর সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে চোখের কেন্দ্রীয় অংশের দৃষ্টি ক্রমে ঝাপসা হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত একদম অন্ধকারে ঢেকে যায় পৃথিবী। এই রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা না থাকলেও, ইউরোপের বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্র এবং চক্ষু হাসপাতালে নতুন এক পরীক্ষামূলক চিকিৎসা শুরু হয়েছে, যেখানে রোগীর চোখে রেটিনার নিচে বসানো হচ্ছে এক ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক মাইক্রোচিপ।
মাত্র ৪ মিলিমিটার আকারের এবং ৩০ মাইক্রোমিটার পুরুত্বের এই চিপটি আসলে একটি প্যাটার্ন কনভার্টার হিসেবে কাজ করে। বিশেষ ধরনের চশমায় লাগানো ক্যামেরা বাইরের দৃশ্য ধারণ করে ইনফ্রারেড আলো হিসেবে চিপে প্রেরণ করে, যা রেটিনায় বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত হয়। এরপর সেই সংকেত মস্তিষ্কে পৌঁছে দৃষ্টিশক্তি আংশিকভাবে ফিরিয়ে দেয়।
৩৮ জন অংশগ্রহণকারী নিয়ে এক বছরের পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৮৪ শতাংশ রোগী এই ডিভাইস ব্যবহার করে পুনরায় অক্ষর ও সংখ্যা পড়তে সক্ষম হয়েছেন। তাদের গড় উন্নতি ছিল স্ট্যান্ডার্ড চোখের পরীক্ষার চার্টে পাঁচ লাইনের সমান।
তবে এই প্রযুক্তির উন্নতির পাশাপাশি সতর্কতার কারণও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ক্ষেত্রে রেটিনায় জটিলতা ও অতিরিক্ত অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়েছে। গবেষকরা বলছেন, মস্তিষ্ক ও যন্ত্রের এই সংযোগ এখনো পূর্ণাঙ্গ নয়—মানব মস্তিষ্ককে এখনও শেখানো হচ্ছে কীভাবে এই কৃত্রিম সংকেত বুঝতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে দৃশ্যমান সংকেতগুলো আরও স্পষ্টভাবে শনাক্ত করা যায়।
এছাড়া, ব্যয়ের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে পরীক্ষায় ব্যবহৃত প্রাইমা নামের ডিভাইসটি ইউরোপীয় ও মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদন পেলে এটি জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করার পথ খুলে যাবে। এক্ষেত্রে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণা ও বেসরকারি বায়োটেক কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে বৃহৎ পরিসরে উৎপাদনের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।
এর আগেও উন্নত মাল্টি-গ্রিপ প্রোস্থেটিক হাতের মতো ডিভাইসগুলো স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যার দাম প্রায় ১৩ হাজার থেকে ৩৭ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত। নতুন প্রজন্মের এই ইমপ্লান্ট আরও এক ধাপ এগিয়ে, যা সরাসরি স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মানুষের সংবেদনশীলতা পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে মানুষ-যন্ত্রের এই সংযোগই চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন যুগের সূচনা করবে। হয়তো আগামী দিনে প্রযুক্তি ও স্নায়ুবিজ্ঞানের এই মেলবন্ধনই দৃষ্টিহীন মানুষের চোখে নতুন করে আলো ফিরিয়ে দেবে।



