যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের হ্যামট্রাম্ক শহরের মেয়র ও ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক আমের গালিব অবশেষে সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির সামনে তাঁর বক্তব্য রাখার সুযোগ পেয়েছেন। কয়েক মাসের বিলম্বের পর এই শুনানিতে তিনি কুয়েতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিজের মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন। মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্টের মনোনীত এই প্রার্থী শুরু থেকেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন—বিশেষত ইসরায়েলবিরোধী মন্তব্যের কারণে।
গালিব ডেমোক্র্যাটিক দলের সমর্থক থাকলেও পরবর্তীতে নির্বাচনের সময় সাবেক প্রেসিডেন্টকে সমর্থন দেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ও সোশ্যাল মিডিয়ার পুরোনো মন্তব্যগুলোই এই মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছিল। ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে তাঁর কঠোর সমালোচনা দেশটির প্রভাবশালী মহলে বিতর্ক সৃষ্টি করে।
শুনানিতে কমিটির ডেমোক্র্যাট সদস্য গালিবের আগের এক মন্তব্যের প্রসঙ্গ তোলেন—যেখানে তিনি হামাসের যৌন সহিংসতার অভিযোগকে “বাইডেন প্রশাসনের মিথ্যা প্রচারণা” বলেছিলেন। জবাবে গালিব জানান, তিনি সবধরনের নির্যাতনের নিন্দা করেন, তবে সেই সময়ের কিছু তথ্য তিনি নিজে দেখেননি। তাঁর দাবি, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শিশুদের শিরশ্ছেদ সংক্রান্ত বক্তব্যের প্রতিবাদে তিনি ওই মন্তব্য করেছিলেন। পরে সেই অভিযোগগুলো ভুল প্রমাণিত হয়।
জাতিসংঘের ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলার সময় যৌন সহিংসতার কিছু প্রমাণ মিলেছে, তবে অনেক অভিযোগ যাচাইযোগ্য নয়। কিছু ঘটনার ভুলভাবে প্রচার হওয়ায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়। গালিব বলেন, তিনি কোনো ধরনের সহিংসতার পক্ষে নন এবং ৭ অক্টোবরের ঘটনাকে “ভয়াবহ এক দিন” হিসেবে দেখেন।
এক রিপাবলিকান সিনেটর তাঁকে প্রশ্ন করেন, কেন তিনি এমন একজন ব্যক্তিকে শহরের পরিকল্পনা কমিশনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, যিনি হলোকাস্ট নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। উত্তরে গালিব বলেন, ওই ব্যক্তি কেবল একজন স্বেচ্ছাসেবক এবং তাঁর মতের সঙ্গে তিনি একমত নন।
আরেক সিনেটর গালিবকে ইসরায়েলবিরোধী “বিডিএস” আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন করেন। মেয়র জানান, বিষয়টি তাঁর উদ্যোগে হয়নি এবং তিনি ব্যক্তিগতভাবে এমন আন্দোলনের সমর্থন করেন না। তিনি ব্যাখ্যা দেন, এই প্রস্তাবটি স্থানীয় এক সংগঠন দিয়েছিল এবং তিনি এতে ভোট দেননি।
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ, যা “আব্রাহাম চুক্তি” নামে পরিচিত, সেই বিষয়ে অতীতের অবস্থান থেকে সরে এসে গালিব বলেন, এখন তিনি বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছেন। ইসরায়েল ইহুদিদের মাতৃভূমি কি না—এমন প্রশ্নে তিনি উত্তর দেন, “এটি ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের জন্য একসঙ্গে বসবাসের ভূমি হতে পারে।”
শুনানিতে গালিব তাঁর মেয়র পদে গৃহীত এক প্রস্তাবের কথাও উল্লেখ করেন, যেখানে তিনি ইহুদিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “ইহুদি সম্প্রদায়ের নেতারা এসে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন, কারণ তাঁদের অনুরোধ ছাড়াই আমরা সেই প্রস্তাব পাস করেছিলাম।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর পুরনো কিছু পোস্টকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেন গালিব। এক পোস্টে “সব ইহুদি বানর” মন্তব্যে লাইক দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি ওই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নই। যিনি লিখেছিলেন তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন।”
কুয়েত ইস্যুতে আরও এক প্রশ্নে গালিবকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, তিনি একসময় ইরাকি এক নেতাকে “শহীদ” বলেছিলেন। জবাবে তিনি বলেন, “আমি তখন একজন সাধারণ নাগরিক ছিলাম এবং ক্ষোভের বশে সেই মন্তব্য করেছিলাম।” পাশাপাশি কুয়েত আক্রমণকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে স্বীকার করে তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ক্ষমা চান।
নিজের জীবনের পটভূমি বর্ণনা করতে গিয়ে গালিব জানান, তিনি ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নেন। প্রথমদিকে কারখানায় কাজ করলেও পরে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা শুরু করেন। যদিও তাঁর ডিগ্রি সম্পন্ন হয়েছে কি না তা স্পষ্ট নয়, তবে তিনি বর্তমানে নিবন্ধিত নার্স হিসেবে পরিচিত।
হ্যামট্রাম্ক শহরটি মূলত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। ২০২২ সালে গালিব এখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পূর্ণ মুসলিম কাউন্সিলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনি স্থানীয় এক কমিউনিটি ক্লিনিকেও কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে সাবেক প্রেসিডেন্টের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন মিশিগান রাজ্যে প্রভাব ফেলেছিল বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন রাজনীতিতে মুসলিম ও আরব ভোটারদের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য ডেমোক্র্যাটদের গালিব ইস্যু নিয়ে কৌশলী হতে হবে। সম্প্রতি গালিব জানিয়েছেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রতি এখনো সমর্থন রাখছেন। এমনকি সম্প্রতি টেলিফোনে তিনি গালিবকে কুয়েতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে সমর্থনের আশ্বাসও দেন।
গালিব সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে হোয়াইট হাউসে গিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রী ও কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং সেই সব ছবি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছেন। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া কতদূর এগোয়, সেটিই এখন রাজনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।



