একটি মাত্র সার্ভার সেন্টারের ত্রুটি যখন থমকে দেয় গোটা পৃথিবীকে—তখন বোঝা যায়, আমরা কতটা নির্ভরশীল প্রযুক্তির উপর। সোমবার অ্যামাজনের ক্লাউড সার্ভিস বা অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস (AWS)-এর এক বড় ধরনের বিভ্রাটে বিশ্বজুড়ে অচল হয়ে পড়ে অসংখ্য অ্যাপ ও ওয়েবসাইট। প্রায় ১৫ ঘণ্টা স্থায়ী এই সমস্যায় দুই হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর কোটি কোটি ব্যবহারকারী লগইন করতে পারেননি স্ন্যাপচ্যাট, রোবলক্স, সিগন্যাল, ডুয়োলিঙ্গোসহ বহু জনপ্রিয় অ্যাপে। এমনকি অ্যামাজনের নিজেদের কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হয়।
এই বিভ্রাট শুধু প্রযুক্তিগত সমস্যা নয়—এটা ছিল এক কঠিন বাস্তবতার বার্তা, যে আমাদের পুরো ডিজিটাল জীবন দাঁড়িয়ে আছে অল্প কয়েকটি ক্লাউড কোম্পানির কাঁধে। আর তাদের যেকোনো একটি ব্যর্থতা পুরো পৃথিবীর কাজ বন্ধ করে দিতে পারে।
যদি বলা হয়, “ডেটা নতুন তেল,” তবে ক্লাউড কম্পিউটিং হলো সেই তেল শোধনাগার, পাইপলাইন, জাহাজ আর পাম্প—সবকিছুই একসঙ্গে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে তিনটি কোম্পানি—অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস, মাইক্রোসফট আজুর এবং গুগল ক্লাউড—মিলেই নিয়ন্ত্রণ করছে প্রায় ৬০% ক্লাউড পরিষেবা। তারা শুধু ডেটা পরিবহনই করে না, সেই ডেটাকে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে নিজেদের প্রযুক্তির মাধ্যমে, যা এতটাই জটিল যে একবার ব্যবহার শুরু করলে অন্য প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তর হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এমনকি অ্যামাজনের অ্যালেক্সা, গুগল ওয়ার্কস্পেস বা মাইক্রোসফট ৩৬৫-এর মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলো মানুষের কাজের ধরণ, যোগাযোগ ও তথ্য ব্যবহারের পদ্ধতিকেও প্রভাবিত করছে।
আমরা প্রায়ই ভুলে যাই—এই সব ডেটা ট্রান্সফার, সার্ভিস আর প্রসেসিং কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘটছে কিছু বিশাল ভবনের ভিতর, যেখানে সারি সারি সার্ভার যুক্ত আছে ফাইবার অপটিক কেবলের মাধ্যমে। অ্যামাজনের সবচেয়ে বড় ক্লাউড কেন্দ্র—“US-EAST-1”—অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায়, যেখানে বিশ্বের প্রায় ৭০% ইন্টারনেট ট্রাফিক প্রবাহিত হয়। তুলনা করলে বলা যায়, তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে যেমন হরমুজ প্রণালীর ভূমিকা, তেমনি ইন্টারনেটের জন্য ভার্জিনিয়া এখন একটি সংকীর্ণ ও সংবেদনশীল নেটওয়ার্ক হাব।
এই অঞ্চল ইতিপূর্বেও তিনবার বড় ধরনের বিভ্রাটের সম্মুখীন হয়েছে, প্রতিবারই যার প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ব্যবস্থায়। প্রযুক্তিগত ত্রুটি ছাড়াও এটি সাইবার হামলা, ভূরাজনৈতিক নাশকতা কিংবা সন্ত্রাসবাদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
এক গবেষণায় বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—২১ শতকের অর্থনীতির শক্তির উৎস এখন ক্লাউড কম্পিউটিং। ইউরোপের শিল্প, সরকারি সেবা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর উদ্যোগগুলো দাঁড়িয়ে আছে এমন এক ডিজিটাল পরিকাঠামোর উপর, যা তাদের নিজস্ব নয়। তারা সেটির নিয়ন্ত্রণ, নীতি বা কাজের ধরন পর্যন্ত পুরোপুরি জানে না। ফলে এই সাম্প্রতিক বিভ্রাট আসলে এক গুরুতর সতর্কবার্তা।
গবেষকেরা প্রস্তাব দিয়েছেন—প্রতিটি দেশকে নিজেদের সার্বভৌম ক্লাউড অবকাঠামো তৈরি করতে হবে, হার্ডওয়্যার সরবরাহে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং নিজেদের মান নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে ইউরোপ বা যুক্তরাজ্য একসময় ডিজিটালভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মতো শক্তিধর দেশের উপর।
কিছু দেশ ইতিমধ্যেই উদ্যোগ নিয়েছে—ভারত ও ব্রাজিল জাতীয় পর্যায়ে নিজস্ব ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলছে, জার্মানি ও ফ্রান্স শুরু করেছে “Gaia-X” প্রকল্প, যেখানে থাকবে নিরাপদ ও স্বচ্ছ ক্লাউড সার্ভিস। এমনকি একটি বড় ইউরোপীয় খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানও নিজেদের ক্লাউড প্রযুক্তি নির্মাণ করছে। কিন্তু যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে এখনো কোনো স্পষ্ট নীতি নেই; ফলে তাদের অধিকাংশ ডিজিটাল অবকাঠামো পরিচালিত হচ্ছে AWS ও মাইক্রোসফটের নিয়ন্ত্রণে।
ব্রিটেনের ডিজিটাল সার্ভিসের এক সাবেক পরিচালক অবশ্য মনে করেন, ক্লাউড মালিকানা বড় সমস্যা নয়—ওপেন স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করলে ক্লাউডের সুবিধা নেওয়া সম্ভব, নিজের প্রযুক্তি তৈরি না করেও। কিন্তু বাস্তবে এতে তৈরি হয় কৌশলগত দুর্বলতা।
কারণ সার্বভৌমত্ব মানে শুধু নীতি নির্ধারণ নয়—তা বাস্তবায়নের ক্ষমতাও। আর যখন সেই ক্ষমতা নির্ভর করে বিদেশি সার্ভারের উপর, তখন তা মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে।
বাস্তব স্থিতিশীলতা মানে হলো, দেশের নিজস্ব সিস্টেমই যেন নাগরিকদের সেবা, ব্যাংকিং, হাসপাতাল কিংবা সরকারি কার্যক্রম সচল রাখতে পারে—বিদেশি সার্ভারের উপর নির্ভর না করে।
অ্যামাজনের সাম্প্রতিক বিভ্রাট তাই কেবল প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়, বরং এক সতর্কবার্তা—ডিজিটাল দুনিয়ায় আসল নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।



