শীতের আগমনে ঠান্ডা ও কাশির প্রকোপ যেন বাড়বেই। বিশেষ করে ছোট্ট শিশুরা যখন কাশিতে কষ্ট পায়, তখন মা–বাবার চিন্তার শেষ থাকে না। তাই দ্রুত উপশমের আশায় অনেকেই কফ সিরাপের আশ্রয় নেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশে কফ সিরাপ খাওয়ার পর শিশু মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ পাওয়ায় এক প্রশ্ন সামনে এসেছে—এই সিরাপগুলো আসলে কতটা নিরাপদ?
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুর কাশির সিরাপে বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদান থাকে—অ্যান্টিহিস্টামিন, ডিকনজেস্ট্যান্ট, এক্সপেক্টোরেন্ট ইত্যাদি। এগুলোর উদ্দেশ্য হলো শ্লেষ্মা কমানো, কফ বের করতে সহায়তা করা ও কাশি দমন করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এসব উপাদান একসঙ্গে কাজ করার ফলে শিশুর শরীরে জটিল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। তাছাড়া এগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তেমন ইতিবাচক ফল দেখা যায় না।
সম্প্রতি যেসব সিরাপ খেয়ে শিশু মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর পরীক্ষায় ‘ডাইইথিলিন গ্লাইকল’ নামক বিষাক্ত উপাদান পাওয়া গেছে। এই রাসায়নিকটি কিডনি বিকলসহ মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি ঘটাতে পারে। অতীতে ‘কোডিনযুক্ত’ কাশির সিরাপগুলোর প্রতিও আসক্তি এবং শ্বাসযন্ত্রের ঝুঁকির কারণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তাই শিশুদের এমন সিরাপ দেওয়া একেবারেই অনুচিত।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ নয়
অভিভাবকেরা প্রায়ই সন্তানের কাশি হলে নিজেরাই ওষুধের দোকান থেকে সিরাপ কিনে খাওয়ান। কেউ কেউ আবার প্রাপ্তবয়স্কদের সিরাপ কম ডোজে শিশুকে দেন—যা আরও বিপজ্জনক। বাজারে অনেক কফ সিরাপ ‘ওভার দ্য কাউন্টার’ হিসেবে পাওয়া যায়, অর্থাৎ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই কেনা যায়। কিন্তু শিশুদের শরীরের গঠন প্রাপ্তবয়স্কদের মতো নয়, ফলে একই উপাদান তাদের শরীরে ভিন্ন প্রভাব ফেলে।
আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস জানিয়েছে, চার বছরের নিচের শিশুদের একদমই কফ সিরাপ দেওয়া উচিত নয়। চার থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শে সিরাপ দেওয়া যেতে পারে। আর সাত বছর বয়সের পর সঠিক মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ করলে তা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।
সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কাশির সিরাপ খাওয়ানোর ফলে শিশুদের নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে—যেমন বমি, মাথাব্যথা, হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, খিঁচুনি, ঝিমুনি, অতিরিক্ত ঘুম বা অস্থিরতা। এর মধ্যে কিছু প্রতিক্রিয়া প্রাণঘাতীও হতে পারে। যেমন অতিরিক্ত ঘুমের কারণে শিশু যথাসময়ে খেতে না পারলে অপুষ্টি ও দুর্বলতা দেখা দেয়।
সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, অধিকাংশ কফ সিরাপ শিশুর জন্য কার্যকর নয়; বরং কিছু উপাদান সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
ঘরোয়া যত্নই হতে পারে নিরাপদ সমাধান
প্রায়ই দেখা যায়, শিশুদের সাধারণ কাশি চিকিৎসা ছাড়াও ভালো হয়ে যায়। শিশুর পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার গ্রহণ, কুসুম গরম পানি খাওয়ানো, নাকে লবণযুক্ত স্যালাইন ড্রপ ব্যবহার, কিংবা গরম পানিতে ভেজানো কাপড় দিয়ে নাক পরিষ্কার—এসব ঘরোয়া উপায় অনেক সময় যথেষ্ট।
প্রকৃতপক্ষে, কাশি সব সময় খারাপ নয়। অনেক সময় কাশির মাধ্যমে শ্বাসনালির ময়লা বা জীবাণু বের হয়ে যায়, যা শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থাকে সহায়তা করে। তবে যদি কাশি দীর্ঘস্থায়ী হয় বা ব্রঙ্কিওলাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, টনসিলাইটিস কিংবা হৃৎপিণ্ডের ত্রুটির মতো রোগের ইঙ্গিত দেয়—তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর কাশি চিকিৎসা করার আগে কারণ শনাক্ত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভুল চিকিৎসা শুধু ক্ষতি বাড়ায়। তাই সন্তান অসুস্থ হলে ওষুধের সহজ সমাধান খোঁজার চেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ পথ।



