বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান উগ্র ডানপন্থার উত্থান নিয়ে জাতিসংঘের এক শীর্ষ বিশেষজ্ঞ গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, বিভিন্ন দেশের সরকার দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলো সীমিত করে আনার ফলে সমাজে একধরনের অনিশ্চয়তা ও হতাশা জন্ম নিয়েছে, যা এখন চরমপন্থী রাজনৈতিক শক্তির উত্থানে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
জাতিসংঘের ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, লন্ডন থেকে শুরু করে ইউরোপের অন্যান্য রাজধানীগুলো পর্যন্ত—বামপন্থী ও উদার ডানপন্থী রাজনীতিকরা বিগত কয়েক দশকে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করেছেন। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের বঞ্চনার অনুভূতি তৈরি হয়েছে। এই শূন্যস্থানকে কাজে লাগাচ্ছে উগ্র ডানপন্থী শক্তি, যারা অভিবাসী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব উসকে দিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে।
তিনি বলেন, যদি রাষ্ট্র নাগরিকদের প্রতি আরও দায়িত্বশীল হতো, মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটা আতঙ্কিত হতো না। ডিজিটাল রূপান্তর, সবুজ অর্থনীতি কিংবা বিশ্বায়নের প্রভাব যে সমাজে কষ্টের কারণ হবে না, সে বিষয়ে মানুষ নিশ্চিত হতে পারত। কিন্তু এখন সাধারণ মানুষ মনে করছে, রাষ্ট্র তাদের পেছনে নেই, ফলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করছে চরমপন্থার মাধ্যমে।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ আজ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এক প্রতিবেদন উপস্থাপন করছেন। প্রতিবেদনে তিনি মানবাধিকারভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানান। তাঁর মতে, খাদ্য সহায়তা, স্বাস্থ্যসেবা ও বেকার ভাতা কেবল ব্যয় নয়—এগুলো একটি স্থিতিশীল সমাজ গঠনের মূল স্তম্ভ। সরকারগুলোর উচিত এগুলোকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখা, বোঝা হিসেবে নয়।
তিনি উদাহরণ হিসেবে পশ্চিমা এক দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন, যেখানে নতুন এক দল অভিবাসনবিরোধী ইস্যুকে পুঁজি করে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। বিশেষজ্ঞের মতে, এর মূল কারণ হলো—রাষ্ট্রীয় সেবাখাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না থাকা। ফলে জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে, আর তাতেই অভিবাসনবিরোধী মনোভাব জোরদার হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে বহু দেশে একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—জার্মানির অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসের ফ্রিডম পার্টি ও ফ্রান্সের ন্যাশনাল র্যালির মতো দলগুলো দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এসব দলের উত্থান সেইসব অঞ্চলে বেশি, যেখানে সরকারি সেবার মান কম, ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত, এবং মানুষ নিজেদের ‘ভুলে যাওয়া নাগরিক’ মনে করে।
জাতিসংঘের ওই কর্মকর্তা বলেন, রাজনীতিকদের দীর্ঘদিনের একটি ভুল ধারণা হলো, সামাজিক ভাতা বা সুবিধাগুলো রাষ্ট্রের জন্য বোঝা। ফলে ভাতাপ্রাপ্তদের কলঙ্কিত করা হয়েছে, প্রক্রিয়া জটিল করা হয়েছে, এমনকি তাদের প্রতি সমাজের সহানুভূতিও কমেছে। এতে করে মানুষের মনে জন্মেছে ‘আমরা বনাম তারা’ মানসিকতা—যেখানে মনে করা হয়, সম্পদের পরিমাণ সীমিত, এবং এক পক্ষ যা পায় অন্য পক্ষ তা হারায়। এই মনোভাব সমাজকে বিভক্ত করছে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
তিনি আরও জানান, একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, আয় বৈষম্য যত বাড়ে, ততই জনতুষ্টিবাদী দলগুলোর প্রতি সমর্থন বাড়ে। বিপরীতে, পেনশন, শিশু ভাতা বা ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি করলে চরমপন্থী দলগুলোর প্রতি ভোটের হার কমে। অর্থাৎ, সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানোই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার চাবিকাঠি।
বিশেষজ্ঞের মতে, অনেক সময় ডানপন্থী দলগুলো দাবি করে, অভিবাসীরা রাষ্ট্রের সামাজিক সেবার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, অভিবাসীরা আসলে কর ও সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলে যে পরিমাণ অবদান রাখে, তার চেয়ে অনেক কম সুবিধা ভোগ করে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, বর্তমান বিশ্বে এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অনেক দেশেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হুমকির মুখে পড়বে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক সুরক্ষার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক অবিশ্বাস—সব মিলিয়ে এমন এক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, যা উগ্র জাতীয়তাবাদ ও বিদ্বেষমূলক রাজনীতিকে পুষ্ট করছে।
জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞ শেষবারের মতো আহ্বান জানিয়েছেন—সমাজের স্থিতিশীলতা ও শান্তি বজায় রাখতে রাষ্ট্রকে নতুন করে ভাবতে হবে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিয়ে। তিনি বলেন, “সরকারি অর্থের সঠিক ব্যবস্থাপনা অবশ্যই জরুরি, কিন্তু তার আড়ালে যেন আমরা এমন এক সমাজ গড়ে না তুলি, যেখানে মানুষ সীমিত সম্পদের জন্য একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে।”



