প্যারিসের লা সান্তে কারাগারে প্রবেশের সময় এক সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্টের দৃঢ় কণ্ঠে প্রকাশিত হলো তার আত্মপক্ষ সমর্থনের বার্তা—“আজ যে মানুষটি জেলে যাচ্ছে, সে একজন নির্দোষ ব্যক্তি।” যদিও আপিল আদালতের রায়েই নির্ধারিত হবে তার কথার সত্যতা, তবে এত বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পতনের এই নাটকীয় দৃশ্য সহজে মুছে ফেলা যাবে না।
২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের সর্বোচ্চ পদে থাকা এই নেতা দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন লিবিয়ার প্রাক্তন শাসক গাদ্দাফির শাসনামল থেকে অবৈধ নির্বাচনী তহবিল নেওয়ার অপরাধে। পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিহাসে প্রথম কোনো সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কারাগারে প্রবেশ করলেন। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিতর্কিত ভিশি শাসনের নেতা পেতাঁর পর এই প্রথম কোনো ফরাসি রাষ্ট্রনেতা কারাভোগ করতে যাচ্ছেন।
ফরাসি সমাজে যেখানে প্রেসিডেন্টকে প্রায় রাজকীয় মর্যাদা দেওয়া হয়, সেখানে এই ঘটনাটি হয়ে উঠেছে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা যেখানে ভয়াবহভাবে কমে গেছে, সেখানে আদালতের এই পদক্ষেপ আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে—আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়।
একটি জরিপে দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ ফরাসি নাগরিক মনে করেন রাজনীতিবিদদের বড় অংশই দুর্নীতিগ্রস্ত এবং নয়জনের মধ্যে প্রায় নয়জনই বিশ্বাস করেন, রাজনীতিকরা জনগণের নয়, নিজেদের স্বার্থেই কাজ করেন। আদালতের বিচারক এই রায়ে উল্লেখ করেছেন, অপরাধের গুরুত্ব এবং তা জনগণের আস্থাকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, তা বিবেচনা করেই তিনি দ্রুত সাজা কার্যকরের নির্দেশ দেন।
এই বক্তব্য হয়তো অনেকের কাছে স্বাভাবিক মনে হতে পারে, বিশেষত যেহেতু এর আগে এই রাজনীতিকের বিরুদ্ধে আরও দুর্নীতির মামলা ছিল। তবে পুরো বিচারের প্রক্রিয়া আবারও দেখিয়েছে, কীভাবে ফ্রান্সসহ বিশ্বের অনেক দেশে বিচারব্যবস্থা এখন নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে—যেখানে আইনের শাসনের পরিবর্তে জনপ্রিয় রাজনীতির চাপ বাড়ছে।
এই মামলাটিকেও তার সমর্থকরা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন, এটি নাকি একপক্ষীয় ঘৃণার ফল। ডানপন্থী রাজনীতিকরা এবং তাদের ঘনিষ্ঠ গণমাধ্যম একযোগে বিচারক ও আদালতের সমালোচনায় নেমেছেন। এর ফলে মামলার মূল বিচারক নানা হুমকি পর্যন্ত পেয়েছেন—যা বিচারব্যবস্থার ওপর এক ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে আশার কথা, সাধারণ মানুষ এসব প্রচারণায় খুব একটা ভরসা রাখেননি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বিচারপ্রক্রিয়া ও রায়ের পক্ষে আস্থা প্রকাশ করেছেন। তবুও রাজনৈতিক অঙ্গনে এই ঘটনাকে অনেকেই ভবিষ্যতের আরও বড় বিতর্কের প্রাক্-মঞ্চ হিসেবে দেখছেন। কারণ আগামী জানুয়ারিতে এক ডানপন্থী নেত্রীর রাজনৈতিক তহবিল আত্মসাতের মামলার আপিল শুনানি রয়েছে। তিনি হেরে গেলে ২০২৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ হারাবেন।
এক বিভক্ত ও অবিশ্বাসপূর্ণ রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেই সময়টি ফরাসি বিচারব্যবস্থার জন্য এক কঠিন পরীক্ষা হতে পারে। যদিও সাবেক প্রেসিডেন্ট তার আইনজীবীদের মাধ্যমে শিগগিরই জামিনের আবেদন করেছেন, তবুও বিচার প্রক্রিয়াকে অবমাননা করে দেওয়া তার ও তার সমর্থকদের মন্তব্যগুলো ইতিমধ্যেই বিপজ্জনক নজির তৈরি করেছে।
এই ঘটনা ফরাসি সমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে—ক্ষমতা, পদ কিংবা মর্যাদা নয়, ন্যায়বিচারের সামনে সবাই সমান। বিচারব্যবস্থার প্রতি অবিশ্বাসের দেয়াল যতই উঁচু হোক, শেষ পর্যন্ত আইনের শাসনই সত্যের সর্বোচ্চ প্রমাণ হয়ে থাকবে।



