স্বাস্থ্যসেবায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এখন আর ভবিষ্যতের কোনো বিষয় নয়—এটা ইতিমধ্যেই হাসপাতাল, ল্যাব ও চিকিৎসকদের প্রতিদিনের কাজে যুক্ত হয়ে গেছে। ওষুধ আবিষ্কার, ক্যানসার স্ক্রিনিং কিংবা মেডিকেল ইমেজ বিশ্লেষণ—সব জায়গাতেই AI তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। তবে এখন এই প্রযুক্তি আরও বড় এক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যবহৃত হচ্ছে—স্বাস্থ্যখাতে বাড়তে থাকা সময়ের চাপ ও প্রশাসনিক জটিলতা সামলাতে।
বর্তমানে চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ সময় ব্যয় করছেন নথিপত্র, রিপোর্ট বা প্রশাসনিক কাজে। এতে করে রোগীর প্রতি মনোযোগ দেওয়ার সময় কমে যাচ্ছে। এই সমস্যা দূর করতে স্বাস্থ্য প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এখন বিভিন্ন AI-ভিত্তিক ফিচার তৈরি করছে—যেগুলো অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকিং থেকে শুরু করে ল্যাব রিপোর্ট বোঝা, এমনকি রিয়েল টাইমে রোগীর তথ্য সংরক্ষণ পর্যন্ত সবকিছুতেই সাহায্য করছে।
স্বাস্থ্য প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের বড় একটি অংশ এখন এসব AI সমাধানেই যাচ্ছে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা-কেন্দ্রিক AI কোম্পানিগুলোর প্রাপ্ত বিনিয়োগের প্রায় ৬০% গেছে প্রশাসনিক ও ক্লিনিক্যাল প্রয়োগে ব্যবহৃত প্রযুক্তির দিকে, এমন তথ্য পাওয়া গেছে এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে।
এর মধ্যে একটি আলোচিত প্রতিষ্ঠান হলো Abridge, যার উদ্দেশ্য “চিকিৎসকদের সময় ফেরত দেওয়া”। এই প্ল্যাটফর্মটি রোগী-চিকিৎসকের কথোপকথন রেকর্ড করে এবং পূর্ববর্তী ভিজিট ও টেস্টের তথ্য ব্যবহার করে তা বিশ্লেষণ করে। এতে চিকিৎসকদের হাতে কাগজপত্র বা রিপোর্ট তৈরিতে যে সময় ব্যয় হতো, তা বাঁচে এবং তারা সরাসরি রোগীর সেবায় বেশি সময় দিতে পারেন।
প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার ভাষায়, “বর্তমানে চিকিৎসকরা প্রতিটি ঘণ্টার সরাসরি রোগীসেবার জন্য দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন ডিজিটাল কাগজপত্র তৈরি করতে। প্রযুক্তি যেন তাদের রোগীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।”
স্বাস্থ্যখাতে কাজ করা বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, চিকিৎসকদের মানসিক অবসাদের অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রশাসনিক চাপ। তাই তারা মনে করেন, AI এই চাপ কমিয়ে তাদের পেশাগত জীবনে নতুন স্বস্তি আনতে পারে। এক স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বলেন, “যতটা সম্ভব এই টুলগুলো ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া উচিত, কারণ এগুলো চিকিৎসা অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করতে পারে।”
তবে এই পরিবর্তনের সঙ্গে একটি বাস্তবতা এসেছে—চিকিৎসকদের এখন নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে এই নতুন প্রযুক্তির জন্য। সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ২৮% চিকিৎসক মনে করেন তারা AI ব্যবহারে প্রস্তুত, যদিও ৫৭% চিকিৎসক ইতিমধ্যেই AI ব্যবহার করছেন ডকুমেন্টেশন, বিলিং বা রোগ নির্ণয়ের কাজে।
এ অবস্থায়, যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় স্বাস্থ্য শিক্ষা নেটওয়ার্ক সম্প্রতি গুগল ক্লাউডের সঙ্গে যৌথভাবে একটি নতুন AI প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করেছে, যা আগামী বছর থেকে শুরু হবে। এতে চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ স্বাস্থ্যসেবা পেশাজীবীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো—AI সম্পর্কিত সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা, যাতে চিকিৎসকরা প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে রোগীসেবা আরও কার্যকরভাবে দিতে পারেন।
প্রতিষ্ঠানের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, “প্রযুক্তি দ্রুত এগোচ্ছে, কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হলো—আমাদের কর্মীদের প্রস্তুতি। কিভাবে আমরা তাদের এই প্রযুক্তি গ্রহণে সক্ষম করব, সেটিই আসল প্রশ্ন।”
তবে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, AI ব্যবহারের ফলে কর্মসংস্থান হ্রাস পেতে পারে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসাক্ষেত্রে মানবিক উপাদানই সবচেয়ে বড় শক্তি, যা কোনো মেশিনই প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। AI চিকিৎসকদের রোগীর কাছাকাছি আসতে সাহায্য করবে, দূরে ঠেলে দেবে না।
একজন বিশেষজ্ঞের ভাষায়, “এই প্রযুক্তি চিকিৎসকদেরকে সেই কাজেই ফিরিয়ে আনবে, যেটির জন্য তারা এই পেশায় এসেছিলেন—রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে সেবা দেওয়া।”



