যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণে শুরু হয়েছে এক নতুন অধ্যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এখন শুধু প্রযুক্তির জগতে নয়, শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরেও জায়গা করে নিচ্ছে দ্রুত। এ পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষক সংগঠনগুলো, যারা এবার হাত মিলিয়েছে বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে। লক্ষ্য একটাই—আগামী প্রজন্মকে এমনভাবে প্রস্তুত করা, যাতে তারা এআই-নির্ভর ভবিষ্যতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে।
এক উষ্ণ শনিবার সকালে সান অ্যান্টোনিও শহরে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মশালা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডজনখানেক শিক্ষক, যাঁরা নিজেদের ছুটির দিনটি উৎসর্গ করেছেন এআই-নির্ভর শিক্ষার সম্ভাবনা জানতে। শ্রেণিকাজ মূল্যায়ন থেকে শুরু করে পাঠ পরিকল্পনাকে পডকাস্ট বা অনলাইন গল্পে রূপান্তর—সব কিছুই ঘটছে মুহূর্তের মধ্যে। তবে অনেকের মনে একটাই প্রশ্ন: “এআই কি আমাদের জায়গা নেবে?”
এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর এখনও মেলেনি। তবে বাস্তবতা হলো, শিক্ষকদের প্রাসঙ্গিক রাখতে এবং শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারে সাহায্য করতে হলে শিক্ষক সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। এজন্যই শিক্ষক ইউনিয়নগুলো যুক্ত হয়েছে মাইক্রোসফট, ওপেনএআই এবং অ্যানথ্রপিকের মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এআই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে দিচ্ছে কোটি কোটি ডলারের অর্থসহায়তা। মাইক্রোসফট প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পাঁচ বছরে ১২.৫ মিলিয়ন ডলার সহায়তার। ওপেনএআই দিচ্ছে ৮ মিলিয়ন ডলার এবং অতিরিক্ত ২ মিলিয়ন ডলার প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসেবে। অন্যদিকে অ্যানথ্রপিক দিচ্ছে ৫ লাখ ডলার। এই অর্থে নিউ ইয়র্কে গড়ে তোলা হচ্ছে এক আধুনিক এআই প্রশিক্ষণকেন্দ্র, যেখানে শিক্ষকদের জন্য থাকবে অনলাইন ও অফলাইন প্রশিক্ষণ সুযোগ। পরবর্তী পাঁচ বছরে অন্তত ৪ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
এদিকে আরেক বড় শিক্ষক সংগঠনও যুক্ত হয়েছে এই অভিযানে। তারা মাইক্রোসফটের কাছ থেকে পেয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ডলারের অনুদান, যা দিয়ে তৈরি করা হবে অনলাইন “মাইক্রোক্রেডেনশিয়াল” কোর্স। এতে অংশ নিতে পারবেন সংগঠনের প্রায় ৩০ লাখ সদস্য। লক্ষ্য, চলতি শিক্ষাবর্ষেই অন্তত ১০ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষিত করা।
এই সমস্ত অংশীদারিত্বের মূল শর্ত হচ্ছে—প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেবেন শিক্ষকরাই, প্রযুক্তি কোম্পানি নয়। প্রশিক্ষণগুলিতে এআই ব্যবহারের পাশাপাশি নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং শিক্ষার্থীদের ডেটা সুরক্ষার বিষয়েও আলোকপাত করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারও এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা ইতোমধ্যে “এআই এডুকেশন টাস্কফোর্স” গঠন করেছে, যার লক্ষ্য বৈশ্বিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নেতৃত্বে দেশকে এগিয়ে নেওয়া। শতাধিক কোম্পানি ইতিমধ্যে এই উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছে শিক্ষা খাত এখন বড় এক সম্ভাবনার ক্ষেত্র। মাইক্রোসফট ঘোষণা করেছে ৪ বিলিয়ন ডলারের এআই শিক্ষায় বিনিয়োগ পরিকল্পনা, যেখানে থাকবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে এআই টুলস ব্যবহারের সুযোগ। গুগলও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারের এআই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তহবিলের, যার মাধ্যমে মার্কিন উচ্চবিদ্যালয়গুলো পাবে তাদের “Gemini for Education” প্ল্যাটফর্মের বিনামূল্যে ব্যবহার অধিকার।
যদিও শিক্ষায় এআই ব্যবহারের হার দ্রুত বাড়ছে, গবেষণায় দেখা গেছে—শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এখনও পর্যাপ্ত নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তি কোম্পানির আর্থিক সহায়তা শিক্ষায় এআই সচেতনতা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে, তবে এই অংশীদারিত্বে শিক্ষকদের স্বার্থই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
প্রযুক্তি জগতের অন্যতম শীর্ষ নির্বাহী নিজেও স্বীকার করেছেন—এআই ব্যবহারে যেমন সম্ভাবনা আছে, তেমনি রয়েছে অজানা ঝুঁকিও। তাঁর ভাষায়, “আমরা এখনো শুরুতেই আছি। তাই সতর্ক থাকা জরুরি।”
অন্যদিকে সান অ্যান্টোনিওর এক প্রশিক্ষণ সেশনে উপস্থিত শিক্ষকরা দেখেছেন, কীভাবে ChatGPT, Microsoft CoPilot বা Google Gemini-এর মতো টুল দিয়ে কয়েক সেকেন্ডে তৈরি করা যায় পাঠ পরিকল্পনা, অনুবাদ বা চিত্রসমৃদ্ধ গল্প। একজন শিক্ষক জানান, এখন তাঁর ছাত্ররা নিজের নামের চরিত্র হিসেবে গল্পের বই পড়তে পারে—যা আগে কখনো সম্ভব ছিল না।
প্রথম শ্রেণির আরেক শিক্ষক বললেন, “এআই আমাদের সময় বাঁচায়, আর পাঠকে করে তোলে আরও আকর্ষণীয়। এখনকার বাচ্চাদের মনোযোগ ধরে রাখতে হলে প্রযুক্তিকেই সঙ্গী করতে হবে।”
এভাবেই শিক্ষক সমাজে শুরু হয়েছে এক নীরব বিপ্লব—যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষককে প্রতিস্থাপন করছে না, বরং তাকে করে তুলছে আরও দক্ষ, আরও কার্যকর।



