Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeসম্পাদকীয়ইউক্রেনের ইইউ সদস্যপদ নিয়ে অচলাবস্থা: ইউরোপীয় ঐক্যের স্বার্থে একক নেতার বাধা অতিক্রমের...

ইউক্রেনের ইইউ সদস্যপদ নিয়ে অচলাবস্থা: ইউরোপীয় ঐক্যের স্বার্থে একক নেতার বাধা অতিক্রমের সময়

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিহাসে এটি এক সংকটপূর্ণ সময়। ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক শীর্ষ বৈঠকে ইউরোপের নেতারা স্বীকার করেছেন—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ এত জটিল ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখে আগে কখনো পড়েনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখন ইউরোপীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, আর তারই মধ্যে ইউক্রেনের ইইউ সদস্যপদ নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, যা ইউরোপীয় ঐক্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইউরোপীয় নেতারা রাশিয়ার আগ্রাসনের জবাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপের দেখা মেলেনি। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার বরফাচ্ছন্ন সম্পদ—প্রায় ১৪০ বিলিয়ন ইউরো—ইউক্রেনের সহায়তায় ব্যবহার করা উচিত কি না, তা নিয়েও এখনো একমত হতে পারেনি ইউরোপীয় নেতারা। একইসঙ্গে আগামী বছর থেকে জার্মান ভূখণ্ডে আবারও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করা হচ্ছে, যা ইউরোপে এক নতুন নিরাপত্তা উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ঐক্য ও সহযোগিতা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। কিন্তু এই ঐক্যের মাঝেই দেখা দিচ্ছে এক বড় অন্তরায়—হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী অরবান-এর কঠোর অবস্থান। ইউক্রেন ও প্রতিবেশী মলদোভার ইইউ সদস্যপদ প্রক্রিয়া তিনি দীর্ঘদিন ধরে আটকে রেখেছেন, যা এখন ইউরোপীয় নিরাপত্তা কৌশলকেই ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।

রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ইউক্রেনকে ইইউ প্রার্থী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও অরবান সরকারের বাধার কারণে আলোচনায় অগ্রগতি ঘটছে না। হাঙ্গেরির বর্তমান নীতি বরাবরই ইউরোপীয় উদার মূল্যবোধের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যালঘু অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মতো মৌলিক বিষয়ের প্রতিও দেশটির অবস্থান নেতিবাচক। এখন সেই নীতিই ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপীয় পররাষ্ট্রনীতিতে।

হাঙ্গেরি একদিকে রাশিয়ার ওপর ইইউ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে দেরি করছে, অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে তেল ও গ্যাসের ব্যবসায়ও নির্ভরতা বজায় রেখেছে। এতে ইউক্রেনের ইইউ সদস্যপদ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়েছে, যা ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা কৌশলের জন্য বিপজ্জনক এক সংকেত।

মূল প্রশ্ন হলো, এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কী করতে পারে? ইইউ কাউন্সিলের সভাপতি প্রস্তাব দিয়েছেন—ভোটের নিয়ম পরিবর্তন করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আলোচনার অগ্রগতি ঘটানো যেতে পারে। কিন্তু এই নিয়ম পরিবর্তনের জন্যও প্রয়োজন হাঙ্গেরির সম্মতি, যা আপাতত অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

তবে একটি বিকল্প পথও তৈরি হচ্ছে। ব্রাসেলস এখন এমন এক পরিকল্পনায় এগোচ্ছে, যেখানে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের অপেক্ষা না করে ইউক্রেন ও মলদোভা নিজেদের সংস্কার ও পরামর্শ প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারবে। এতে কিয়েভের জন্য এটি এক বড় মানসিক প্রেরণা হতে পারে, বিশেষ করে এমন সময়ে যখন অরবান নিজ দেশে নির্বাচনের আগে ইউক্রেন ইস্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।

অন্যদিকে, মলদোভা সম্প্রতি জাতীয় নির্বাচনে ইউরোপপন্থী দলের বিজয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ দিক স্পষ্ট করেছে, যা ইউরোপীয় সমর্থনের যোগ্য।

অরবান সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন যে, তিনি ইইউ সদস্য দেশগুলোর ওপর “নৈতিক চাপ” প্রয়োগ করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, হাঙ্গেরির নেতৃত্বই এখন ইউরোপীয় পররাষ্ট্রনীতিকে অচল করে তুলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অরবানের রাজনৈতিক অবস্থান আগামী বছরের নির্বাচনে দুর্বল হতে পারে, তবে তার আগ পর্যন্ত ইউরোপীয় ঐক্যের স্বার্থে তাকে এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—কীভাবে একটি সদস্য দেশের স্বার্থ রক্ষা করে পুরো মহাদেশের নিরাপত্তা ও ঐক্যকে অটুট রাখা যায়। ইউক্রেনের ইইউ সদস্যপদ কেবল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি ইউরোপের ভবিষ্যৎ শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রতীক। আর সেই প্রতীককে অচল করে রাখা মানেই ইউরোপীয় ঐক্যের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেওয়া।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments