যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ভোগব্যয়ের প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তবে তা সমানভাবে নয়। সমাজের ধনী শ্রেণির ব্যয় দ্রুত বাড়লেও সাধারণ ও মধ্যবিত্ত আমেরিকানরা সেই গতির ধারেকাছে নেই। ফলে অর্থনীতিতে একধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এক সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মহামারির পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ভোগব্যয়ের যে উল্লম্ফন ঘটেছে, তার মূল অংশটাই এসেছে উচ্চ আয়ের শ্রেণি থেকে। অপরদিকে দেশের নিচের ৮০ শতাংশ মানুষ কেবল মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়েই ব্যস্ত। অর্থাৎ, তাদের প্রকৃত ব্যয় বাড়ছে না, বরং জীবনযাপন টিকিয়ে রাখতে অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়ছে তারা।
একজন অর্থনীতিবিদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অর্থনীতি ধনীদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ধনীদের আত্মবিশ্বাস ও ক্রয়ক্ষমতা যতদিন স্থির থাকবে, ততদিন অর্থনীতি সচল থাকবে। কিন্তু তারা যদি ব্যয়ে সতর্ক হয়ে যায়, তাহলে মন্দার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ধনীদের সম্পদ দ্রুত বাড়লেও চাকরির বাজারে প্রবৃদ্ধি তেমন নেই। পণ্যের দাম বেশি থাকায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও স্থবির। ফলে নিচের সারির জনগোষ্ঠী অর্থনীতির সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তথ্য বলছে, মহামারির পর থেকে নিচের ৮০ শতাংশ মানুষ ব্যয়ে কেবল মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়েছে। কিন্তু শীর্ষ ২০ শতাংশ, বিশেষ করে সবচেয়ে ধনী ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের মোট ব্যয়বৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে।
২০২২ সালের শেষ দিক থেকে ধনী ও মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত শ্রেণির মধ্যে আয়ের ব্যবধান আরও বেড়েছে। যাদের বার্ষিক আয় ১ লাখ ৭৫ হাজার ডলারের নিচে, তারা ব্যয় বাড়াতে পারেননি। অথচ শীর্ষ ধনী শ্রেণি তাদের ব্যয় সূচক প্রায় ১৭০ পয়েন্টে নিয়ে গেছে, যেখানে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সূচক দাঁড়িয়েছে ১২০ পয়েন্টে। অর্থাৎ, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এখন মূলত ধনীদের হাতেই বন্দি।
এক অর্থনীতিবিদের ভাষায়, “যুক্তরাষ্ট্রের বাজার এখন ধনীদের ব্যয়ের ওপর নির্ভর করছে। তারা ব্যয় করলেই অর্থনীতি সচল, কিন্তু ব্যয় কমলেই বড় ধাক্কা আসতে পারে।”
ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে
ফেডারেল রিজার্ভের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ধনীরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত সম্পদশালী হচ্ছে। নিচের ৫০ শতাংশ মানুষের মোট সম্পদ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার—এক বছরে সামান্য প্রবৃদ্ধি। অপরদিকে মধ্যবিত্তদের সম্পদ বেড়ে ৪৮ ট্রিলিয়নের ঘরে পৌঁছেছে। কিন্তু সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর সম্পদ এখন ৫৮ ট্রিলিয়নের বেশি।
সবচেয়ে ধনী শূন্য দশমিক ১ শতাংশ শ্রেণির হাতে এখনো দেশের মোট সম্পদের প্রায় পাঁচগুণ বেশি সম্পদ রয়েছে, যা নিচের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর মোট সম্পদের তুলনায় বিশাল। এই ক্ষুদ্র ধনী শ্রেণির সম্পদ ক্রমাগত বাড়ছে এবং সম্পদের কেন্দ্রীকরণ আরও গভীর হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী ধনী ব্যক্তিদের সংখ্যাও বেড়েছে। বর্তমানে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে, যা এক বছর আগের তুলনায় দুই শতাধিক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রেই এখন শীর্ষ ধনীদের হাতে দেশের মোট পারিবারিক সম্পদের প্রায় ১৪ শতাংশ।
তাদের বিলাসব্যসনও বাড়ছে, যদিও তার ধরন কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে—এখন তারা প্রাচুর্য নয়, বরং ‘এক্সক্লুসিভিটি’ বা বিশেষত্বের দিকে ঝুঁকছে।
খুচরা বিক্রি এখনো স্থিতিশীল
চাকরির বাজার কিছুটা দুর্বল হলেও যুক্তরাষ্ট্রে খুচরা বিক্রি এখনো স্থিতিশীল। আগস্ট মাসে খুচরা বিক্রি বেড়েছে ০.৬ শতাংশ, যা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। সেপ্টেম্বরেও একই প্রবণতা বজায় ছিল।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, স্কুল খোলার মৌসুমে ব্যয়ের চাপ কিছুটা বাড়লেও ভবিষ্যতে সেটি কমতে পারে। কারণ, সাম্প্রতিক মাসগুলোর ব্যয় মূলত মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেড়েছে, প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে নয়।
এছাড়া, ভবিষ্যতে শুল্ক বাড়ার আশঙ্কায় অনেক ভোক্তা আগেভাগেই কেনাকাটা সম্পন্ন করেছেন, যার প্রভাব অক্টোবরের পর থেকে কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।



