আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সম্প্রতি সতর্ক করে জানিয়েছে, উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন বর্তমানে সবচেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকিতে রয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও, যেখানে শুল্ক নীতির কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে, তবুও ব্রিটেনের পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। দেশটির মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাত্র ০.৪ শতাংশ—যা জি-৭ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল। এদিকে, বাস্তব মজুরি টানা ১১ মাস স্থবির, আর বেকারত্বের হার বেড়ে ৪.৮ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০২১ সালের পর সর্বোচ্চ।
অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ বলছে, ব্রিটেনের অর্থনীতি এখন এমন এক অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যেখানে লাভ বাড়ছে ব্যবসায়ীদের হাতে, কিন্তু কর্মজীবীরা রয়ে যাচ্ছেন স্থবির আয়ে। অর্থাৎ, অর্থনীতি “লাভে গরম, মজুরিতে ঠান্ডা।” সরকারের তথাকথিত ‘বৃদ্ধি’ আসলে শুধুই মুনাফা সংগ্রহকারীদের জন্যই উপকারী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জোসেফ রাউন্ট্রি ফাউন্ডেশনের (জেআরএফ) এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২৯ সালের মধ্যে গড় গৃহস্থালি ব্যয়যোগ্য আয় আজকের তুলনায় ৫৭০ পাউন্ড কমে যেতে পারে—যা ১.৩ শতাংশ হ্রাস নির্দেশ করে। ১৯৬১ সালের পর এটিই হবে জীবনযাত্রার মানে সবচেয়ে বড় পতন। এটি কেবল দামের উর্ধ্বগতি নয়, বরং “প্রফিট ইনফ্লেশন”—যেখানে উৎপাদনশীলতা না বাড়লেও পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, অথচ কর্মীদের বেতন স্থির। এই পরিস্থিতিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি মূলত শ্রম থেকে মূলধনের দিকে সম্পদের স্থানান্তর।
অন্যদিকে, ট্রেজারি এখনো বিশ্বাস করে যে মোট ব্যয় পর্যাপ্ত এবং অর্থনীতি পূর্ণ কর্মসংস্থানে পৌঁছাতে পারবে। তাদের মতে, মজুরি বৃদ্ধির ধীরগতি এবং আমদানি ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি মুদ্রাস্ফীতির কারণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য এই ধারণার বিপরীত ইঙ্গিত দিচ্ছে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড জানিয়েছে, চাকরির সংকটের একটি কারণ হলো “চাহিদার দুর্বলতা”। গৃহস্থালি সঞ্চয়ের হার ১১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা অতিমারি পর্ব বাদে গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ—এটি কোনো উচ্ছ্বাস নয়, বরং অর্থনৈতিক সতর্কতার প্রতীক।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই অবস্থায় ব্রিটেনের আরও কঠোর ব্যয়সংযম নয়, বরং দরকার লক্ষ্যভিত্তিক ব্যয় বৃদ্ধি। বাজেট ঘাটতি এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিত যাতে তা বাণিজ্য ঘাটতির ভারসাম্য রাখতে পারে—না হলে চাপ গিয়ে পড়বে সাধারণ পরিবার ও ক্ষুদ্র ব্যবসার ওপর। পাশাপাশি, সামাজিক ব্যয় এবং সরকারি সেবা বাড়িয়ে সম্পদশালীদের বদলে সাধারণ মানুষের হাতে আর্থিক সাপোর্ট পৌঁছে দেওয়া জরুরি।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাষ্ট্রের উচিত জ্বালানি, বাসস্থান এবং পরিবহনের মতো মৌলিক চাহিদাগুলোকে সাশ্রয়ী করার উদ্যোগ নেওয়া। কারণ, এটি শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং অর্থনৈতিক প্রয়োজনও। পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা থাকলে তারা শিক্ষা ও দক্ষতায় বিনিয়োগ করতে পারে, ঝুঁকি নিতে পারে—যা শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে।
কিন্তু বর্তমান নীতিতে শ্রমজীবী মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর পরিবর্তে সম্পদের মূল্যবৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। বিরোধীদলে থাকা অবস্থায় লেবার নেতৃত্ব কর ফাঁকি ও মূলধন মুনাফায় শিথিলতা পুনর্মূল্যায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা এখন বাস্তবায়নের সময় এসেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমান সরকার যদি বাস্তব মজুরি হ্রাস ও মূল্যবৃদ্ধির ধারা বন্ধ করতে না পারে, তবে জনগণের আস্থা হারানোর ঝুঁকি বাড়বে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, কেবল সম্পদমূল্য বাড়িয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই হয় না। ২০০৮ সালের আর্থিক ধসের আগেও এমনই ভুল পথে চলেছিল ব্রিটেন, যার পরিণতিতে ক্ষমতা হারায় তৎকালীন সরকার। এবারও সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হলে ফলাফল ভিন্ন হবে না।



