গাজায় দীর্ঘ দুই বছরের সংঘাতের অবসানের পর মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে কূটনৈতিক আলোচনার ইঙ্গিত মিলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি তাঁর মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য এক নতুন চুক্তির কথা উল্লেখ করে ‘বন্ধুত্বের হাত’ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এই বক্তব্যের আড়ালে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা দেখছেন এক জটিল বাস্তবতা—যেখানে বন্ধুত্বের আহ্বানের পাশাপাশি রয়ে গেছে কড়া অবস্থান ও সামরিক হুমকির ছায়া।
ইসরায়েল সফরের সময় দেশটির সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমরা প্রস্তুত, যখন তোমরাও প্রস্তুত হবে। এটি ইরানের জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হবে, এবং আমি বিশ্বাস করি, এটি ঘটবেই।” তিনি আরও যোগ করেন, “বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার দরজা খোলা আছে। আমরা যদি চুক্তিতে পৌঁছাতে পারি, তা হবে দারুণ এক সাফল্য।”
তবে তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যেই ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থান অটল রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকেরা বলছেন, পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক এখনো অচলাবস্থায়। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ হামলায় তেহরানের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে। অনেকেই মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতির আড়ালে আসলে চাপের কৌশল প্রয়োগ করছে।
ইরানের অবস্থান: কূটনীতি এখনো খোলা, তবে সতর্ক
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে জানান, যুক্তরাষ্ট্র যদি “যুক্তিসংগত ও ভারসাম্যপূর্ণ প্রস্তাব” দেয়, তবে তেহরান তা বিবেচনা করবে। তবে একই সঙ্গে দেশটি গাজা যুদ্ধ নিয়ে মিসরে আয়োজিত সম্মেলনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ও নিষেধাজ্ঞাকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে।
২০১৮ সালে প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ায়। এবার ওয়াশিংটন বলছে, নতুন কোনো চুক্তিতে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। কিন্তু এই শর্ত আগের চুক্তির সীমার বাইরে এবং ইরান একে তার সার্বভৌম অধিকারে হস্তক্ষেপ বলে মনে করছে।
ইরানের দাবি, আন্তর্জাতিক অস্ত্র বিস্তাররোধ চুক্তি অনুযায়ী (NPT) ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিষিদ্ধ নয়। ফলে এই ইস্যুই এখন আলোচনার সবচেয়ে বড় অন্তরায়। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্প যতই শান্তির বার্তা দিন না কেন, তিনি মূলত ইরানকে সম্পূর্ণ সমর্পণে বাধ্য করতে চাইছেন।
সামরিক বাস্তবতা ও আঞ্চলিক প্রভাব
ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে তেহরানের বহু শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। এতে ইরান আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, তাদের হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি “প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে”, যদিও আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থা (IAEA) বলছে, ইরান কয়েক মাসের মধ্যেই আবার কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে পারবে।
অন্যদিকে ইসরায়েল ইরান ও এর মিত্র সংগঠনগুলোর ওপর হামলা চালিয়ে চলেছে। এতে ইরান কৌশলগতভাবে প্রতিরক্ষায় ব্যস্ত এবং আলোচনার টেবিলে ফেরার আগে পরিস্থিতি বিশ্লেষণে সময় নিচ্ছে।
সময়ের খেলায় ট্রাম্পের সুবিধা
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক বিশ্লেষক বলেন, প্রেসিডেন্ট সময়কে কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি আশার কথা বললেও বাস্তবে ইরানকে অপেক্ষার মধ্যে রেখে চাপ সৃষ্টি করছেন। তাঁর মতে, “ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি দুর্বল হয়েছে, আর তারা পুনর্গঠনের চেষ্টা করলে আবারও হামলার মুখে পড়বে।”
জাতিসংঘও সম্প্রতি ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের উদ্যোগে ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, অভিযোগ করে যে ইরান পূর্ববর্তী চুক্তির শর্ত ভেঙেছে। পাল্টা ইরান জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালেই একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে গিয়েছিল, ফলে তাদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা অন্যায্য।
সামনে কী?
পরিস্থিতি এখনো অনিশ্চিত। ট্রাম্প প্রশাসন বন্ধুত্বের হাত বাড়ালেও বাস্তবিক অর্থে আলোচনার ক্ষেত্র কঠিন। ইরান কূটনীতি চালু রেখেছে, কিন্তু তাদের আস্থা ক্ষয়প্রাপ্ত। অন্যদিকে ওয়াশিংটন পারমাণবিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধের দাবি থেকে একচুলও নড়ছে না।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ট্রাম্প হয়তো কয়েক মাস সময় নেবেন—দেখবেন অর্থনৈতিক চাপ বাড়লে ইরান নিজে থেকেই আলোচনায় ফিরে আসে কি না। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পথ এখনো কণ্টকাকীর্ণ, এবং ‘বন্ধুত্বের হাত’ সত্যি না কূটনৈতিক কৌশল—তা সময়ই বলে দেবে।



