নিউইয়র্কের একটি ফেডারেল ভবনে ঘটছে এমন কিছু দৃশ্য, যা মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলছে নতুনভাবে। এক অভিবাসী দম্পতির অভিজ্ঞতা যেন সেই বাস্তবতারই প্রতিফলন।
এক নারী তার স্বামীর নিয়মিত অভিবাসন শুনানিতে উপস্থিত হয়েছিলেন। বিচারক তার স্বামীকে পরবর্তী শুনানির জন্য সময় দেন, এতে পরিবারের মনে আশার সঞ্চার হয়— হয়তো সাময়িকভাবে নির্বাসন স্থগিত হলো। কিন্তু আদালতের কক্ষ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
অভিবাসন কর্মকর্তারা হঠাৎ করে তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে, আর নারীটি চিৎকার করে স্বামীর হাত ধরে রাখার চেষ্টা করলে একজন কর্মকর্তা তাকে মাটিতে ফেলে দেয়। নারীটি বলেন, “ওরা আমাদের পশুর মতো আচরণ করেছে।”
এই ঘটনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, ভবনটির অভ্যন্তরে অভিবাসন দপ্তরের কর্মকাণ্ড ক্রমেই ভয় এবং অনিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
এক অভিবাসন সহায়তা সংস্থার আইনজীবী বলেন, “এই ভবনে কাজ করা প্রত্যেকের জন্য এটি এক রকম মানসিক আঘাত। পরিবারের সদস্যদের চোখের সামনে বিচ্ছিন্ন হতে দেখা এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।”
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আদালতের ভেতরে এমন একাধিক বিশৃঙ্খল গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। একদিন দুপুরে আদালতের বাইরে প্রায় এক ডজন কর্মকর্তা এক অভিবাসী পুরুষ ও তার পরিবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিশুসহ সেই পরিবার চিৎকার করলেও পুরুষটিকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঘটনাটি এতটাই বিশৃঙ্খল ছিল যে বিচারক আদালতের দরজা বন্ধ করে দেন। পরে জানা যায়, শিশুর নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে দপ্তর আশ্বাস দিয়েছে, তবে পরিবার চায়নি তাদের সন্তান আলাদা হোক।
অন্যদিকে, সাংবাদিকদের সঙ্গেও কর্মকর্তাদের রূঢ় আচরণের খবর পাওয়া গেছে। সম্প্রতি দুজন সাংবাদিককে ঘটনাস্থল কভার করার সময় মাটিতে ফেলে দেয় কর্মকর্তারা। তাদের একজনকে হাসপাতালে নিতে হয়। ঘটনার পর সাংবাদিক সংগঠনগুলো গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে।
সরকারি এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন, তখন কিছু ব্যক্তি ও সাংবাদিক “অপারেশন বাধাগ্রস্ত” করায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের ওপরও বলপ্রয়োগ করেছেন।
নিউইয়র্কের এই ফেডারেল ভবনটি এখন অভিবাসন আদালত ও নির্বাসন কার্যক্রমের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিউইয়র্ক অঞ্চলে যত অভিবাসীকে আটক করা হয়েছে, তার অর্ধেকেরও বেশি এখান থেকেই।
এমনকি যাদের অপরাধের কোনো রেকর্ড নেই, তারাও গ্রেপ্তার হচ্ছেন। অনেকেই এখন আদালতে হাজিরা দিতে ভয় পাচ্ছেন। এক আইনজীবী জানান, “মানুষ এখন মনে করছে আদালতে গেলেই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। কিন্তু হাজিরা না দিলে আদালত স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের নির্বাসনের নির্দেশ দেয়।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রক্রিয়া অভিবাসন ব্যবস্থাকে অন্যায্য করে তুলছে। আদালত এখন ন্যায়বিচারের জায়গা না হয়ে, অনেকের জন্য ভয়ের স্থান হয়ে উঠেছে।
সরকারি পক্ষ অবশ্য দাবি করছে, তারা কেবল অপরাধীদেরই লক্ষ্য করছে এবং আদালতের ভেতরে গ্রেপ্তার নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয়।
তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন কথা বলছে। বহু মানুষ যাদের আশ্রয়ের আবেদন বিচারাধীন, তারাও এখন গ্রেপ্তারের শিকার হচ্ছেন।
নিউইয়র্কের ওই নারীর অভিজ্ঞতা যেন তার জীবনের আরেকটি নির্মম অধ্যায়। নিজ দেশে অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে তিনি আমেরিকায় এসেছিলেন, কিন্তু এখানেও সেই ভয়াল অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি দেখছেন। তার কথায়, “আমার মনে হয় আমি এখন আর মানুষ নই, যেন মূল্যহীন এক প্রাণ।”
এই ঘটনাগুলো আমেরিকার অভিবাসন নীতির বাস্তব চিত্র তুলে ধরছে— যেখানে আদালতের মেঝেতে পড়ে থাকা মানুষগুলোই মানবতার এক নির্মম সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।



