বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশটি আবারও চাঁদে মানুষ পাঠানোর স্বপ্নে বিভোর। দশকের শেষ নাগাদ এই অভিযান সম্পন্ন করার ঘোষণা যেমন উত্তেজনা ছড়িয়েছে, তেমনি বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কা। কারণ, পরিকল্পনাটি যতটা উচ্চাভিলাষী, বাস্তবায়ন ততটাই কঠিন ও অনিশ্চিত।
চাঁদে ফেরার এই অভিযানে ব্যবহৃত হবে সর্ববৃহৎ রকেট সিস্টেম—একটি নতুন প্রজন্মের মহাকাশযান, যা এখনো পরীক্ষামূলক ধাপে রয়েছে। বহু পরীক্ষায় আংশিক সাফল্যের পাশাপাশি বেশ কয়েকবার ভয়াবহ ব্যর্থতাও ঘটেছে। সর্বশেষ একটি পরীক্ষামূলক যানের বিস্ফোরণ এই প্রকল্পকে নিয়ে আরও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আগামী সপ্তাহেই পরবর্তী পরীক্ষার সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে, যা এই পরিকল্পনার অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে এখনো পর্যন্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বাকি। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থানরত অবস্থায় মহাকাশযানে জ্বালানি ভরার প্রক্রিয়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে। এত বড় আকারের যানকে মহাকাশে পুনরায় জ্বালানি সরবরাহ করার অভিজ্ঞতা কারও নেই, ফলে এই অংশটিই পুরো মিশনের সাফল্য নির্ধারণ করতে পারে।
কতবার জ্বালানি ট্যাংকার পাঠাতে হবে, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। কেউ বলছেন দশটি মিশন যথেষ্ট, আবার কেউ মনে করছেন অন্তত ৪০টি ফ্লাইট লাগবে পূর্ণ জ্বালানি সরবরাহ করতে। এমন ভিন্নমতের মাঝেই প্রকল্পের সময়সূচি আরও দীর্ঘ হচ্ছে।
এক সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বর্তমান মহাকাশ পরিকল্পনার কাঠামো এতটাই জটিল যে, এটি সফল করতে এক দশক সময় লেগে যেতে পারে। তাঁর মতে, এই ধরনের স্থাপত্য কোনো প্রশাসক স্বেচ্ছায় বেছে নিতেন না—কিন্তু তখনকার পরিস্থিতিতে সেটিই গ্রহণ করা হয়েছিল। বর্তমান প্রশাসন অবশ্য আত্মবিশ্বাসী যে তারা নির্ধারিত সময়ের আগেই লক্ষ্য পূরণ করবে।
তবে বাস্তবতা বলছে, চাঁদের দৌড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশটি ইতিমধ্যেই দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই মহাকাশচারী পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে সময় ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির চাপ আরও বেড়েছে।
এই প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে “আর্তেমিস–৩”। এটি আগের শতকের অ্যাপোলো মিশনের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কাঠামোর। তখন একটি মাত্র রকেটেই সবকিছু ছিল—অ্যাপোলো ক্যাপসুল, চাঁদে নামার ল্যান্ডার—সব একত্রে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। আগের যুগের যন্ত্রপাতি, সরবরাহ চেইন ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা আর বর্তমান নেই। তাই এই নতুন অভিযানে একাধিক ধাপ এবং একাধিক মহাকাশযানের সমন্বয় ঘটাতে হচ্ছে।
এই অভিযানের লক্ষ্য শুধু পতাকা গেড়ে ফেরা নয়; বরং চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে তোলা, যেখানে বরফ আকারে থাকা পানিকে ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করা যাবে। এজন্য দরকার বৃহৎ, শক্তিশালী এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য ল্যান্ডার—যা কেবল এই নতুন প্রজন্মের মহাকাশযানই দিতে পারে।
তবুও অনেকে মনে করছেন, পরিকল্পনাটি অতি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। মহাকাশে তরল জ্বালানির সঠিক তাপমাত্রা ধরে রাখা, পুনরায় স্থানান্তর করা—সবই নতুন চ্যালেঞ্জ। এক বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেন, “এই প্রক্রিয়া কতটা কার্যকর হবে, তা এখনো কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।”
বর্তমান রূপরেখা অনুযায়ী, একাধিক ট্যাংকার মহাকাশে জ্বালানি সরবরাহ করবে, তারপর মানুষের জন্য নির্ধারিত ল্যান্ডারটি সেই জ্বালানিতে ভর করে চাঁদের পথে যাত্রা করবে। অন্যদিকে, মহাকাশচারীরা আরেকটি যান “অরিয়ন”–এ চড়ে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছাবেন, সেখানেই দুই যান যুক্ত হবে। তারপর দুজন মহাকাশচারী নামবেন দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে। এক সপ্তাহ গবেষণার পর তারা ফিরে এসে অরিয়নে যোগ দেবেন, যা তাদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে।
তত্ত্বগতভাবে এই পরিকল্পনা যদি ২০২৭ সালের মধ্যে সফল হয়, তবে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশটির আগে চাঁদে পৌঁছে যাবে। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা, তহবিল সংকট এবং সময়ের সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে সেটি এখনো অনিশ্চিত।
তবুও আশাবাদী মহাকাশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতের সফল প্রকল্পগুলো প্রমাণ করে দিয়েছে—এই সংস্থা অসম্ভবকে সম্ভব করতে জানে। সময় লাগলেও, শেষ পর্যন্ত তারা গন্তব্যে পৌঁছাবে বলেই তাঁদের বিশ্বাস।



