ক্যারিবীয় সাগরে সম্প্রতি মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলায় ধ্বংস হওয়া একটি নৌযান নিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট দাবি করেছেন, হামলায় বিধ্বস্ত নৌযানটি ছিল কলম্বিয়ার এবং এর ভেতরে ছিলেন দেশটিরই নাগরিকেরা। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযোগকে সম্পূর্ণ “অমূলক” বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
গত কয়েক সপ্তাহে মার্কিন বাহিনী ক্যারিবীয় অঞ্চলে অন্তত চারটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে, যাতে ২১ জন নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এই নৌযানগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমায় ছিল এবং “মাদক চোরাচালানকারী”দের লক্ষ্য করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। তবে কারা এই নৌযানগুলোতে ছিলেন বা তাদের পরিচয় কী—সে বিষয়ে ওয়াশিংটন এখনো কোনো প্রমাণ বা বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি। ফলে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ক্যারিবীয় অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশ মার্কিন পদক্ষেপের সমালোচনা করছে।
মার্কিন সিনেটে সম্প্রতি একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল, যাতে প্রেসিডেন্টের অনুমতি ছাড়া এমন সামরিক হামলা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। তবে প্রস্তাবটি ৪৮-৫১ ভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়। ফলে প্রেসিডেন্টের হাতে ক্যারিবীয় অঞ্চলে সামরিক পদক্ষেপ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা বহাল থাকে।
ঘটনাটি নিয়ে এক মার্কিন সিনেটরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পোস্টের জবাবে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেন, “নতুন এক যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে—ক্যারিবীয় সাগর।” তাঁর দাবি, “সর্বশেষ যে নৌযানটি বোমা হামলায় ধ্বংস হয়েছে, সেটি কলম্বিয়ার এবং তাতে আমাদেরই নাগরিকরা ছিলেন। আমি আশা করি নিহতদের পরিবার সামনে আসবেন এবং বিষয়টি জানাবেন।”
তিনি আরও বলেন, “এটা কোনো চোরাচালানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, বরং তেলকে কেন্দ্র করে নতুন সংঘাত শুরু হয়েছে। এটি লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলজুড়ে এক ধরনের আগ্রাসন, যা থামাতে হবে বিশ্ব সম্প্রদায়কেই।”
তবে কলম্বিয়ার এই দাবি নিয়ে প্রেসিডেন্ট আরও কোনো অতিরিক্ত তথ্য দেননি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র নিহতদের পরিচয় সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেনি।
হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা আশা করছে কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট তাঁর “অমূলক ও অনুপযুক্ত” বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “দুই দেশের মধ্যে কিছু নীতিগত মতভেদ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কলম্বিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাবে।”
মার্কিন সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, ২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই সামরিক অভিযানগুলোর লক্ষ্য ছিল ভেনেজুয়েলার উপকূলবর্তী অঞ্চল, যেখানে তারা অভিযোগ করেছে যে, মাদকবাহী নৌযানগুলো আন্তর্জাতিক জলসীমা অতিক্রম করছিল।
তবে প্রশ্ন উঠেছে, এই হামলাগুলো আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বৈধ কি না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের এই অভিযানকে “অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাতের অংশ” হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করছে। কংগ্রেসে পাঠানো এক ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রশাসন “যুদ্ধকালীন ক্ষমতা” প্রয়োগের আইনি ভিত্তি তৈরি করছে, যাতে তারা “শত্রু যোদ্ধা” হিসেবে যেকোনো ব্যক্তিকে লক্ষ্যবস্তু করতে পারে, এমনকি যদি তারা সরাসরি কোনো সহিংস হুমকি না-ও হয়ে থাকে।
এর আগে মার্কিন প্রশাসন মেক্সিকো, ইকুয়েডর এবং ভেনেজুয়েলার একাধিক মাদকচক্রকে “সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার ফলে এসব অভিযানে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের আরও স্বাধীনতা তৈরি হয়েছে।
কলম্বিয়া সরকারের মতে, এই ধরণের অপ্রকাশিত সামরিক হামলা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্যও তা উদ্বেগজনক। বর্তমানে উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বেড়ে গেছে, যদিও উভয় পক্ষই সহযোগিতা বজায় রাখার কথা বলছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কারণ আন্তর্জাতিক জলসীমায় কোনো দেশের সামরিক পদক্ষেপ অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনার পর লাতিন আমেরিকার দেশগুলো নতুনভাবে তাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক নীতিমালা পর্যালোচনা করতে বাধ্য হবে।



