সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশ করেছে মানব পাচারবিরোধী প্রতিবেদনটির ২৫তম সংস্করণ। প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী দেশগুলোকে জোরপূর্বক শ্রম ও যৌন পাচারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আহ্বান জানায় এবং যে দেশগুলো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাদের জন্য কঠোর পরিণতির বার্তা দেয়।
পররাষ্ট্র দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মৌলিক নীতিগুলো রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, “আমরা এমন এক পৃথিবী গড়তে চাই যেখানে জোরপূর্বক শ্রম, যৌন শোষণ কিংবা মানব পাচারের কোনো স্থান থাকবে না। যারা এই অপরাধকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।”
মানব পাচার কেবল একটি ভয়াবহ অপরাধই নয়, এটি আন্তর্জাতিক অপরাধচক্র ও অনৈতিক সরকারগুলোর অর্থনৈতিক উৎস হিসেবেও কাজ করছে। অনেক দেশ সরকারি পর্যায়ে মানব পাচার রোধে উদ্যোগ নিলেও, কিছু রাষ্ট্র এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে জোরপূর্বক শ্রম চালিয়ে যাচ্ছে—যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইনের চরম লঙ্ঘন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক দেশে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এমন সম্পত্তির মালিক যেখানে অনলাইন প্রতারণার মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের জোর করে শ্রম ও অপরাধে নিযুক্ত করা হয়।
কিছু দেশ রাজনৈতিক বিরোধীদের শাস্তি দিতে এখনো বাধ্যতামূলক শ্রমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর কোরিয়ায় প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ কারাগারে বা শ্রম শিবিরে আটক রয়েছে। এদের অনেককে “শিক্ষার মাধ্যমে পুনর্বাসন” নামের আওতায় জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত করা হয়। একইভাবে, রুশ বাহিনী ইউক্রেনের দখলকৃত অঞ্চলে আটক অনেক ইউক্রেনীয় নাগরিককে জোর করে শ্রমে নিযুক্ত করছে, যার মধ্যে ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করা বা মৃতদেহ সরানো পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রতিবেদনটি আরও জানায়, কিছু দেশ নিজেদের নাগরিকদেরই বাধ্যতামূলক শ্রমে নিযুক্ত করছে। যেমন, একটি লাতিন আমেরিকান দেশ ২০২২ সালে চিকিৎসা সেবা রপ্তানির মাধ্যমে প্রায় ৪.৯ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। কিন্তু সেই আয় এসেছে রাষ্ট্রীয় মানব পাচারের মাধ্যমে পরিচালিত চিকিৎসা মিশন থেকে, যেখানে চিকিৎসকদের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয় জোরপূর্বক এবং আইনগত প্রক্রিয়াকে অপব্যবহার করে।
একইভাবে, পূর্ব এশিয়ার এক দেশ তার সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী—উইঘুর, কাজাখ ও কিরগিজদের—বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করছে। সরকার পরিচালিত এই নীতিতে ব্যাপকভাবে আটক ও শ্রমে নিযুক্ত করার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের পরিপন্থী।
এইসব দেশের সরকার ও কর্মকর্তারা অন্যদের জোরপূর্বক শ্রমে নিযুক্ত করে বিপুল আর্থিক লাভ করছে, যা কেবল ভুক্তভোগীদেরই ক্ষতি করছে না, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতি ও অন্য দেশগুলোর জনগণকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে মানব পাচার প্রতিরোধে উদাহরণ স্থাপন করতে। এজন্য সরকারি পর্যায়ে কঠোর আইন প্রণয়ন, দোষীদের শাস্তি প্রদান এবং অভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও প্রক্রিয়াগুলো সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে সরকারি সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা কমে আসে।
প্রতিবেদনটি আরও উৎসাহ দিয়েছে মানব পাচারবিরোধী সংগঠন ও আন্দোলনগুলোকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও কৌশল নিয়ে এগিয়ে আসতে। এতে বলা হয়, “মানব পাচারকারীরা যেমন সৃজনশীল ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তেমনি মানব পাচারবিরোধী আন্দোলনকেও আরও উদ্ভাবনী ও স্থিতিশীল হতে হবে। গত ২৫ বছরের মতো আগামী সময়েও এই লড়াইকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।”



